স্বাতী।
স্বাতী কি বলতো কে জানে? আদৌ কিছু বলতো কিনা! হঠাৎ এই সময় প্রায় আছাড় খেতে খেতে ছুটে এল ঝিলিক মা-মণি।! মা-মণি! বিন্দুমাসি না কী অসভ্য জানো? বলছে, আমরা আর কক্ষণো এখানে আসব না। মামার বাড়িই থাকব। এখানে। বাপী শুধু একা থাকবে।
অরিন্দম তার এই রুষ্ট ক্ষুব্ধ উত্তেজিত বছর পাঁচেকের মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে প্রবল শক্তিতে গলার কাছে ঠেলে ওঠা হাহাকারটাকে গলার মধ্যে আটকে রেখে বলল, তোমার বিন্দুমাসি একটা বোকা।
হি হি হি। ঠিক বলেছ বাপী। বোকার ঢিপি একেবারে। বলে কিনা, দেখিস আমার কথা সত্যি হয় কিনা?
আশ্চর্য! এই যখন তখন বেহেড হয়ে যাওয়া মাতাল আর শিথিল চরিত্র জুয়াড়ি বাপের প্রতি লেশমাত্রও ঘৃণা অবজ্ঞা বিতৃষ্ণা দেখা যায় না ঝিলিকের। বাপের গালে গালটা নিবিড় করে চেপে ধরে আদুরে গলায় বলে, থাকলেই হলো! আমার যেন
ও অঙ্ক পরীক্ষা নয়। আমরা তো শুধু দিদিভাইয়ের অসুখ দেখে কালই চলে আঘ, তাই না মামণি?
হ্যাঁ, মেয়ের কাছে এই কথাটাই বলা হয়েছিল। বাড়ির কাজ করা লোকেদের কাছেও। স্বাতীই বলেছিল। শাটিনের যে জামাটা ফেঁসেই গিয়েছে, সেটাকেই কোনোমতে ব্যাধিগ্রস্ত দেহটায় ঢাকা চাপা দিয়ে এখানের মঞ্চে যবনিকা টেনে বিদায় নিতে চাইছিল।
কিন্তু দেখা গেল, স্বাতীর সে চেষ্টা সফল হয়নি। বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল স্বাতী। যে ব্যাপারটাকে সে ঘুণাক্ষরেও ওদের কাছে প্রকাশ করেনি, যার জন্যে আজ পর্যন্ত সংসার মঞ্চের সমস্ত খুঁটিনাটি অনিয়টিও নির্ভুল ভাবে করেছে; শঙ্কুকে বলে রেখেছে মাছের খানিকটা যেন আগামীকালের জন্য ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখে, রান্না করা কড়াটা যেন তুলে না রেখে মাজতে দেয়। বিন্দুকে বলেছে, চায়ের বাসনগুলো আর একটু সাফ করে ধুয়ো বিন্দু। দেখ কী রকম দাগ ধরে রয়েছে। এমন কি বেরোতে দেরি হবে বুঝেও ঝিলিকের মাস্টারমশাইকে আসতে বারণ করে দেয়নি।
হ্যাঁ, রাতের দিকেই চলে যেতে চায় স্বাতী। সেখানে গিয়েই যাতে শুয়ে পড়তে পারে। সদ্য সদ্য কারো সঙ্গে কথা বলতে না হয়। আর এখান থেকেও শত চক্ষুর সামনে দিয়ে–। যদিও মেয়ে নিয়ে আর মাঝারি একটা সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে পড়ার। মধ্যে কারো কোনো সন্দেহ উদ্রেকের কারণ থাকার নয়। তবু চোরের মন ভাঙা বেড়ায়।
কিন্তু এত সতর্কতা সত্ত্বেও ওই বিন্দু কোম্পানী রহস্যভেদ করে বসে আছে। রাগে মাথা জ্বলে গেল স্বাতীর।
আর কী দরকার ছেঁড়া পোশাক টেনেটুনে গা ঢাকার চেষ্টায়?
তাই স্বাতী রূঢ় গলায় বলে ওঠে, না! চলে আসব না। আমরা ওখানেই থাকব। ওখান থেকেই পরীক্ষা দেবো। এখানে আর আসব না।
আঁ আঁ অ্যাঁ। কক্ষণো না। ও বাপী। দেখো না—
বাপীর শরণ নিলেও, তার কোল থেকে সড়াৎ করে নেমে পড়ে ঝিলিক। ঘরের মধ্যে দাপাদাপি করে বেড়ায়, মায়ের শাড়ি ধরে টান মারে। নিজের ক্লিপ-আঁটা পরিপাটি আঁচড়ানো চুলগুলোকে দুহাতে টেনে খামচে ক্লিপ খুলে ফেলে নুড়ো নুড়ো করে বলতে থাকে, কেন আমরা ওখানেই থাকব? ওটা তো টিনাদি আর বাপ্পাদার বাড়ি। আমরা কেন সবদিন থাকব? আমাদের বুঝি নিজেদের বাড়ি নেই?
না, নেই।
নিষ্ঠুরতার হিংস্র খেলায় মেতে উঠতেই বুঝি স্বাতীর গলা থেকে একটা অমোঘ স্বর বেরিয়ে আসে, মেয়েদের নিজেদের কোনো বাড়ি থাকে না। চিরকাল তাদের পরের বাড়িই থাকতে হয়।
ছোট্ট মেয়েটার ওপর এই রূঢ় আঘাত হয়তো স্বাতীর এই ছেড়ে চলে যাওয়া বাড়িটার মালিকের প্রতি একটা কুদ্ধ ঈর্ষা থেকে জমে ওঠা।।
ওর সব ঠিকঠাক রইল। এই সাজানো ঘরবাড়ি জানলায় জানলায় রঙিন পর্দা, দেওয়াল ধারে রঙিন টিভি, দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি, টেবিলে ফুলদানী, ওয়ার্ডরোবের মাথায় তিব্বতী বুদ্ধমূর্তি, কাশ্মীরী আখরোট কাঠের আঙুরগুচ্ছ, ঝকঝকে স্টীলের ফ্রেমে আটকানো ঝিলিক-এর প্রথম স্কুলে যাওয়ার স্কুল-ড্রেস-পরা ছবিটি।..খাবার টেবিলে নুন মরিচের শৌখিন কৌটো, ফ্রীজে মাছ, কী নয়?
সব, সব। যেখানে যা কিছু সাজিয়েছিল স্বাতী এই আটটা বছর ধরে, তার একচুল এদিক ওদিক হবে না। শুধু স্বাতীই এখান থেকে পিছনে সরে গিয়ে আবার সেখানে গিয়ে পড়বে, যেখানে স্বাতীর জন্যে এখন আর কোনো জায়গা নেই। অনধিকারিণীর ভূমিকা নিয়ে কয়েকটা বোদা মুখের সামনে ঘুরে ফিরে বেড়াতে হবে। আর বাইরে ছুটোছুটি করে বেড়াতে হবে পায়ের তলার জন্যে একটু মাটি খুঁজে বেড়াবার জন্যে। যে বাড়িতে সেই তার জন্মাগারে মাটির প্রশ্ন নেই স্বাতীর। তার বাবা দুহাতে রোজগার করেছেন দুহাতে খরচ করে গেছে, চিরকাল ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়ে গেছে। আজো সেটাই ঝিলিকের মামার বাড়ি।
সে বাড়িতে একদা স্বাতীর নিজস্ব একখানা ঘর ছিল। পড়ার টেবিল পাতা ছিল। এখন সেটা টিনা আর বাপ্পার পড়ার ঘর।
স্বাতী জানে এসব। স্বাতীর চোখে ভেসে ভেসে উঠছে তার মায়ের ঘরের অর্ধাংশটুকু। লু স্বাতীর চলে যাওয়া ছাড়া পথ নেই। আগুন থেকে তো ছুটে পালাতে হবে। তারপর জলে তলিয়ে যাবে, না চোরাবালিতে পা ফেলে ধসে বসে যাবে, কে জানে!
তবে কেন স্বাতী রূঢ় থেকে রূঢ়তর হবে না, ওই ছোট্ট মেয়েটার ওপর? এটাই তো অরিন্দমকে ঘায়েল করবার একটা প্রকৃষ্ট হাতিয়ার।
অসভ্যতা কোরো না বলছি ঝিলিক। চলো খেয়ে নেবে চলো।