জোবেদা খালার নবনব বেশ, নবনব রূপের উৎসও বুঝি এই? কিন্তু একটি জিনিস এখনও রহস্যময়। যে বসন্ত এসেছিল, দেহমনকে সাজিয়েছিল রঙে রঙে মায়াবী নেশায় সে যখন চলে গেল ঝরাপাতার সঙ্গে তাঁর সমস্ত স্মৃতিও কি চির অবলুপ্ত হয়ে গেছে? আজকে অন্য ঋতু অন্য পরিচ্ছদ, কিন্তু পূর্বরাগিনীর সামান্য অংশও কি এর অন্তরালে লুকিয়ে নেই? তা জানতে বড় ইচ্ছে।
গাড়ি থেকে নামবার পর জেটির ধারের একটি পালের নৌকা ভাড়া করে উঠে পড়লাম। আজ শনিবার, ভিড় মন্দ নয়। অনেক দল উপদল, বিভিন্ন জাতের মেয়ে পুরুষ বেরিয়ে পড়েছে। সমস্ত খাড়িটা জুড়েই জাহাজ, নৌকা, লঞ্চের আনাগোনা। চেয়ে চেয়ে দেখি, যেন একটা গতিময় ছবি, নৌকোর গলুইয়ের কাছে বসে স্কেচের খাতাটা খুলোম। ছোট মেয়েদুটো কৌতূহলী হয়ে কাছে এলো।
বাইরে অবশ্যি কাজ করছি, কিন্তু ভেতরটা শান্ত হয় নি। ম্যানোরায় গিয়েও নয়। সামনে আরব সাগর, অন্তহীন খোলা সমুদ্র, একটানা হাওয়ার সঙ্গে ফেনিল ঢেউ সস শব্দে আছড়ে পড়ছে। বালির ওপরে লেপটে বসে চা-খাওয়া, সমুদ্রে নামা, স্বল্প পানি মাড়িয়ে অনেক দূরে হেঁটে যাওয়া, হাসি ঠাট্টা তামাসা হৈ-চৈ চিৎকারের মধ্যে আমার সারাক্ষণের নিভৃত চিন্তা একটি ছোট্ট ইচ্ছেয় এসে কেন্দ্রীভূত হলো। একটা জিনিস শুধু পরীক্ষা করে দেখব আমি একটা জিনিশ যার ওপরে আমার সমগ্র সৃষ্টিকেই দাঁড় করাতে চাই। সে হলো জীবনের উৎসমূলে অবগাহন।
সূর্য ডুবেছে, নেমে আসছে ছায়া অন্ধকার। ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় বসে পড়েছে সবাই, ফেরার সময় হলো। আমরা হাঁটছিলাম পাশাপাশি, কিছুদূরে চলে এলাম। সমুদ্রের দিকে একেবারে চেয়ে নিয়ে হঠাৎ আমি কথা বলে উঠি, আচ্ছা খালা একটা প্রশ্ন জিগ্গেস করলে কিছু মনে করবেন না তো?
আমার কণ্ঠস্বর এমন একটা খাদ থেকে বেরিয়ে এলো যে চমকে উঠলেন জোবেদা খালা। হাসবার চেষ্টা করে বললেন, কি যে তুই বলিস, মনে করবার মতো কি এমন কথা?
না তেমন কিছু নয়। আমি অকম্প গম্ভীর স্বরে জিগগেস করলাম, আচ্ছা, আহাদ সাহেবকে আপনার মনে পড়ে না?
কে? বিকারগ্রস্ত রোগীর মতোই তির্যক প্রশ্ন।
আহাদ সাহেব, আপনার প্রথম স্বামী। এরপর কি ঘটল বলতে পারবো না, একটা চোরাবালির ধ্বস বুঝি নিচে ডেবে গেল আচমকা। আসলে এটা আমার মনের ভুল। আর্তনাদের মতো একটা অস্ফুট শব্দ করে জোবেদা খালা বসে পড়লেন শুধু। নিচু হয়ে আমি শুধিয়ে উঠলাম, কি হলো, খালা?
কিছু হয় নি জাহেদ! আমাকে একটু ধর তো! একেবারে নির্বাপিত শীতল কণ্ঠস্বর। হাত ধরে তুলতে গিয়ে দেখি তার দুই চোখ বেয়ে দদর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁট কাঁপছে। এরপর থরথর করে সমস্ত শরীরটাই কাঁপতে লাগল। বিস্মিত হওয়ারও সময় নেই। মুখটা একবার আকাশের দিকে তুলে পরক্ষণেই একটা তীব্র কাতরানির সঙ্গে লুটিয়ে পড়লেন বালির ওপর।
বেশি দূরে ছিল না, আর্তনাদ শুনে সবাই ছুটে এলো। সকলের মুখেই একই প্রশ্ন, কি হলো?
আমি তখন আত্মস্থ শান্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বললাম, বড় মামার ছোট ছেলেটা মারা গেছে বলতেই কেমন হয়ে গেলেন!
আরও কত ঘটনা! ছোটবেলায় কঠিন অসুখ হয়েছিল; নাড়ি বন্ধ, মরে গেছি বলে বাড়িতে ক্রন্দনের রোল উঠেছে এমন সময় সবাই অবাক হয়ে দেখে আবার শ্বাস নিচ্ছি।
পরে একজন আত্মীয় নাকি বলেছিলেন, এ ছেলে জীবনে কিছু করবে, নইলে এমনভাবে বেঁচে উঠল!
জানিনে কথাটা কতখানি ঠিক। তবে যে ক্রমে কেন্দ্রীভূত ও আত্মস্থ হয়ে যাচ্ছি তা স্পষ্টই বুঝতে পারি।
পঞ্চাশ বছরের বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল বলে আমাদের পাশের বাড়ির জহু ফাঁস নিয়েছিল। গিয়ে দেখেছি, সতেরো বছরের ওর ডাগর দেহটা গাছের ডালা থেকে ঝুলছে, চোখ ওলটানো, জিভটা বেরিয়ে পড়েছে, খানিক বিশ্রী বিদঘুঁটে চেহারা। জহু ছিল মুখরা, হরিণীর মতো চঞ্চলা, বনে ঘুরে বেড়াত উড়োচুলে, দেখা হলেই বলতো, আমার একটা ছবি একে দে-না রে জাহেদ, তোকে আমি একটা চৈতা শালিকের বাচ্চা দিব নে। মুন্সীবাড়ির আমগাছের বাসায় ডিম পেড়েছে।
কিইবা আঁকতাম তখন, আমার পেন্সিলের কাজ ড্রয়িং মাস্টার খুবই প্রশংসা করতেন এইমাত্র।– তবু অনেকদিন বলার পর জহুকে নিয়ে বসলাম একদিন, স্কেচের খসড়াও একটা করলাম।
কিন্তু ওটা শেষ করার আগেই ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আর আসতে পারে নি।
০২. শুরুটা ভালো ছিল
শুরুটা ভালো ছিল, কিন্তু আমার কাছে শেষটাই বরং দামি। নৌকায় তুলতে ও খাড়ি পেরনোর পর নৌকা থেকে গাড়িতে উঠিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতে বেশ কষ্ট হলো বটে; তবু পাওনার তুলনায় সেটুকুন কিছুই নয়।
বন্ধুরা অভিসারী, আর আমি কামরার ভেতর বালিশে হেলান দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে কাত হয়ে আছি। জানালা খোলা। দেখা যাচ্ছে নগরীর লাল নীল সবুজ আলোকমালা। হঠাৎ গুপ্তধন পেয়ে যাওয়ার পর কৃপণের মতো আমি শিহরিত, সতর্ক তাই বাইরের ঠিকরানো হাতছানি চোখে পড়লেও ভেতরে কোনো সাড়া তুলছে না। বরং আমি ক্রমে নিজের ভাবনার রেশমি জালের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছি।
জীবন বারবার নিজেকে আমার কাছে অনাবৃত করে ধরেছে এটাই আশ্চর্য। আচমকা একেকবার পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে অঙুলি-সঙ্কেত করেছে ভেতরের দিকে, এই রঙ্গমঞ্চ। তার পাশেই সাজঘর। সেখানে আসলরূপে ঘুরে বেড়াচ্ছে অভিনেতা অভিনেত্রী, কোনো প্রসাধন নেই আবরণ নেই। বাইরে যাদের চেনা যায় না সেখানে তারাই নিজ নিজ বেশে প্রতিষ্ঠিত। দেখতে ভয় লাগে কিন্তু একবার দেখতে শিখলে তার ভয়ঙ্কর নেশাই পেয়ে বসে।