এ আবার কি ঘাবলায় পড়া গেল। কোনো অশুভ লক্ষণ নয় তো?
ইঞ্জিনের পরীক্ষা ও মেরামত শেষ হলে বিমান আবার ছাড়ল সোয়া বারোটায়। এবার আকাশের আরো ওপর দিয়ে চলেছে। কাছে দূরে দেখা যায় ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো আবছা মেঘের সম্ভার। মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে এই মেঘকেই কত না কল্পনায় মণ্ডিত করেছি, অথচ এরা সত্যিই নিষ্প্রাণ বাষ্পের আয়োজন মাত্র!
তেমনি বাইরের রঙিন আলোর লেখন দেখে, সোনালি রুপালি চাকচিক্য দেখে, কোনদিন ভুলিনি এমন নয়, এমনকি মোহগ্রস্তও হয়েছি। কিন্তু আজ সে সব যেন মনে হচ্ছে অন্তঃসার শূন্য ফানুসের মতো ফাঁকা!
এই বিমানটি যদি হঠাৎ দুর্ঘটনায় পড়ে এবং সমস্ত সঙ্গীর মতো আমার দেহটিও টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে যায় তবে আমার কোনো দুঃখ থাকবে কি? থাকবে দুঃখ থাকবে মৃত্যুর মুহূর্তে একান্ত সাধারণ একটি মেয়ের আটপৌরে হাতের কোমল স্পর্শ কপালে লাগল না বলে, তার চোখের দুইফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল না বলে আমার বুকের ওপর! এই দুঃখ সাধারণ, এই দুঃখ অসাধারণ।
যশগৌরবের দাম অনেক এবং কৃতীমাত্রেরই তা কাম্য। কিন্তু আমি উপলব্ধি করেছি এসবের চাইতেও যা বড় তা হচ্ছে একটি ছোট্ট মুখে এক টুকরো হাসি ফোঁটানো।
বন্ধুরা বলবে আমি ভুল করছি, একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ওপর নিজের হাতেই যবনিকা টেনে দিয়েছি।
আমি বলব যথার্থ। কারণ তাঁদের মতো মহান শিল্পী আমি হতে চাই না। সব মানবের শিরোমণি যারা তারা আমার নমস্য কিন্তু একজনের ছোট্ট হৃদয়ের সবটুকু অধিকার করে বেঁচে থাকাই আমার লক্ষ্য। কালের অতল গর্ভে তলিয়ে যাব, হারিয়ে যাব। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। কিন্তু তবু যাওয়ার বেলায় আমার ঠোঁটে থাকবে বিজয়ীর হাসি এবং এটাই আমার বিদ্রোহ, এটাই আমার বিপ্লব। হাওয়ার ওপরে ভেসে বেড়ানো নয়, বসুন্ধরার দৃঢ় ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে কাজ করা। পুরাতন দুর্গকে ভেঙে নতুন প্রাসাদ গড়ে তোলার এই একমাত্র পথ। অন্যথায় আত্মধ্বংসই হবে সার।
ইঞ্জিনের একটানা ঘরঘর শব্দ। না, ইঞ্জিনের নয় আমার মস্তিষ্কের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে অবিচ্ছিন্ন উৎকট সঙ্গীতের ঐকতান। ঘুম আসেনি কিন্তু চোখ মেলবার ক্ষমতাও ছিল না। চোখের পাতা বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে থাকি।
সে কতক্ষণ তাও বলতে পারব না। এরপর একসময় সত্যি চোখ মেলোম। দেখি অন্য দৃশ্য। সূর্য দেখা দিচ্ছে। বিমানটা একটি সুতীক্ষ্ণ তীরের মতো রাতের অন্ধকার থেকে দিনের আলোতে ছুটে গেল। তৎক্ষণাৎ হয়তো ঝকঝক্ করে উঠল ওর ধাতব শরীর।
ক্যাপ্টেনের শান্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ডিয়ার প্যাসেঞ্জারস্ গুডমর্নিং টু ইউ অল। বাই দি গ্রেস অব অলমাইটি, উই হ্যাভ রিচড্ ঢাকা যাস্ট অ্যাট্ সিক্স ফিফ্টিন এ এম। থ্যাঙ্ক ইউ।
বিমানবন্দর থেকে বাসে আসবার সময় হাঁসের পালকের মতো মনটা হাল্কা হয়ে গেল। নগরীতে ফেলে এসেছি কুটিলতা, আকাশে উড়িয়ে দিয়েছি দুশ্চিন্তা এবং এখন যা আছে তা হলো নদীতে ডুব দিয়ে গা জুড়িয়ে নেয়ার আকণ্ঠ আকাক্ষা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ভাবারও সময় নেই। এয়ার অফিসের কাছে এসে থাকলে বাস থেকে নেমে রিকশায় উঠে পড়ি।
পরিচিত পথঘাট, পরিচিত মানুষের মুখের আদল, পরিচিত দোকান রেস্তোরাঁ কিন্তু তার চেয়েও পরিচিত আমার পাজরের ভেতরে যে এখন হৃৎপিণ্ডটা ঢিঢ়ি করছে তা! এমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছি কেন? এ চার দিনে অঘটন কিছু ঘটেনি তো? ছবি ভালো আছে? টুলটুল?
মাথায় টুপি দেওয়া কতকগুলো লোক রাস্তার পাশ দিয়ে মুর্দার খাট বয়ে নিয়ে গেলে ভেতরটা ছাৎ করে ওঠে। না, এদের মধ্যে চেনা কেউ নেই।
গেটের কাছে গিয়ে রিকশা থামতেই জলদি করে নেমে পড়লাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ও কে? চোখ তুলে ভালো করে দেখবার আগেই ছুটে এলো সরুপাড় সালোয়ার কামিজ পরা সেই মূর্তিটি, আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে আমার খুব কাছে এখন, আমি কোনমতে আত্মসম্বরণ করে বলি, ছবি, আমার ছবি!
আমার বুকের ভেতরেই যেন বলছে, আমি জানতাম তুমি আসবে, তুমি আসবে আজ। সেজন্য প্লেনের শব্দ শুনেই বাইরে এসেছিলাম।
বুকের মাঝখান থেকে মুখটা দু’হাতে তুলে দেখি ওর চোখজোড়া অশ্রুজলে ভরা। কিন্তু সে অশ্রুজল নয়, আনন্দের মণিমুক্তা। এত সুন্দর হয়েছে ছবি!
ইস্ কাঁদছ দেখছি? শোনো লক্ষ্মী তোমাকে ছেড়ে আর কখনো কোথায়ও যাব না। বাঁ-হাতে সুটকেসটা তোলবার পর ডানহাতে ওকে ঝাঁপটে ধরে এগুতে এগুতে বললাম, চলো অনেক সুখবর আছে, ঘরে চলো।
তখন ভোরের সূর্যের রঙিন ধারা আমাদের দুজনের ওপর ঝলকে ঝলকে পড়ছে। এই সূর্য আদিম এবং অকৃত্রিম; কিন্তু আজকে যেন তারই পুনরাবৃত্তি নয়; বরং তার সন্ধানী সঙ্কেতে আমাকে নতুন সৃষ্টির মর্মমূলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সত্যি, অনুভূতির এক আশ্চর্য মুহূর্ত, একে ব্যর্থ হতে দেব না। ছবি আমার পাশেই ছিল, আর টুলটুলকে কোলের ওপর ধরে আমরা দুজনে সেই আলোর মুখোমুখি দাঁড়ালাম।