দেরি হলো কোথায়? সাতদিন থাকার কথা ছিল, চারদিনে ফিরে এলাম!
চারদিন না ছাই, চার বচ্ছর বলো! ছবির যুক্তির সঙ্গে সত্যি পেরে ওঠা দায়।
সকালে এয়ার অফিসে গিয়ে ভাগ্যক্রমে একটা টিকিট পেয়ে গেলাম। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় ফ্লাইট এরই মধ্যে তৈরি হয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ওখান থেকে বাজারে গিয়ে কিছু ফলমূল কিনি। ভালো কিছু নেই। মালক্কাই নিতে হলো বেশি। টুলটুলের জন্য একটা খেলনা উড়োজাহাজ ও কিছু গরম কামাকাপড় কিনলাম। কিন্তু ছবির জন্য নেব। কি? ও কিছু বলেনি। বলেছিল তুমি শুধু ফিরে এসো ব্যস আর কিছু চাই না।
কিন্তু আমি দোকানে গিয়ে ওর জন্য একটা সুন্দর কাশ্মীরী চাদর একটা হাল্কা নীল নাইলনের শাড়ি ও ব্লাউজের কাপড় কিনে ফেললাম। এসব দেখে জানি প্রথমে ও তিরস্কার করবে কিন্তু সে আর কতক্ষণ! প্রত্যেকটাই মনোমত জিনিস, তাই একটু পরেই ফুটবে ঠোঁটে ভুবন-ভোলানো মধুর হাসি।
এটাই আমি চেয়েছিলাম, এখনো তাই চাই! টুলটুলের জন্মের আগে ও কেমন কাঠির মতো হয়ে গিয়েছিল, হাসতে পারত না। কিন্তু আনন্দিত দেখলে আমি খুশি হই। বলে জোর করে হাসত। একদিন আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে বলল, জানো মেয়েরা কিসে ভাগ্যবতী?
না তো? এমনভাবে বললাম যেন কিছুই জানি না।
ভাগ্যবতী মেয়েরা স্বামীর আগে মরে এবং স্বামীর কোলে মাথা রেখে মরে!
আজ হঠাৎ এসব কথা কেন তুমি বলছো ছবি!
ছবি বুকের ওপরেই কাত হয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল, আমার বড় ভয় হচ্ছে, এবার বাঁচবো না! কিন্তু মরতে আমার কোনো দুঃখ নেই। কারণ তোমার বুকে এমনিভাবে মাথা রেখেই মরতে পারবো তো!
আমি ওর মাথার একগোছা চুল নিয়ে বলি, ছিঃ ছবি। এমন কথা বলতে নেই। আমি দুঃখ পাই!
জানো দুঃখ পাওয়া তোমার দরকার। বড় আঘাতে না পেলে বড় শিল্পী হওয়া যায় না। আমি মরে গেলে তুমি সেই আঘাতে পেতে পারো। তখন কত বড় শিল্পী হবে তুমি, সেই খুশিতে আমার কবরে ফুল ফুটবে! ছবি একটু নীরব থাকার পর বলেছিল, কিন্তু আমি বোধ হয় মরতে পারব না, সে যে ডাকে এখনো! আজ দুপুরে জানো কি হয়েছে শুনি স্টুডিওতে শিশুর কান্না দৌড়ে গিয়ে দেখি কেউ নেই মিনিটা মিউমিউ করছে।
আমি গভীর আদরের সঙ্গে হাত দিয়ে ওর মুখটা মুছে দিতে দিতে বললাম, সে যখন কোলে আসবে তখন দেখো সব ঠিক হয়ে গেছে! ভাবনার কিছু নেই।
আমি মিথ্যে বলিনি। টুলটুলকে কোলে পেয়ে ছবি আত্মহারা। ভাবটা হারাই হারাই ভয়ে গো তাই বুকে চেপে রাখতে চাই কেঁদে মরি একটু সরে দাঁড়ালে জানিনে কোন্ মায়ায় কেঁদে বিশ্বের ধন রাখব বেঁধে আমার এ ক্ষীণ বাহুদুটির আড়ালে।
তাই বসুন্ধরার জন্য বিশেষভাবে সিটিং দেওয়াতে হয়নি। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে আমার সত্তায় যে সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল সেই তো প্রতিকৃতি!
জিনিসপত্রগুলো হোটেল রেখে একজিবিশনে গেলাম। দুপুরে দর্শকের ভিড় নেই কিন্তু বন্ধুদের আড্ডা জমজমাট। হলঘরে ঢুকতেই কয়জন রৈ রৈ করে এগিয়ে এলো। তবে একজন মেয়ে ছিল বলে খুব বাড়াবাড়ি করতে পারল না।
এসো পরিচয় করিয়ে দিই, রায়হান হাত ধরে টেনে মেয়েটার সামনে নিয়ে বলল, মাদার আর্থের আর্টিস্ট মি. জাহেদ। আর ইনি মিস সারা আহমদ! স্কালপচার কোর্স কমপ্লিট করে লণ্ডন থেকে ফিরেছেন!
আচ্ছা! বেশ বেশ। কিন্তু আর কি বলবো খুঁজে পেলাম না।
সো হ্যাপি টু মিট ইউ মি. জাহেদ। সারা লিপস্টিক মাখা মোটা ঠোঁটজোড়া নড়িয়ে বললেন, আই লাইক ইওর পেইন্টিং মাচ। ইটস রিয়্যালি নাইস।
থ্যাঙ্কইউ ফর ইওর কমপ্লিমেন্টস্। বাট আই থিঙ্ক ইটস অনলি এ পিস অব প্রিলিমিনারি ওয়ার্ক!
ও শিওর শিওর! এভরি জেনুইন আর্টিস্ট স্যুড হ্যাভ দিস নোশন অ্যাবউট হিজ ওয়ার্ক। আদারওয়াজ হি উইল ডিমিনিশ এভরিডে, আই হ্যাভ দি গুড় অপরচুনিটি অব ওয়ার্কিং উইথ অ্যাপসটাইন। আই হ্যাভ সিন হাউ টেরিফিক হি ওজ! অ্যান্ড পিকাসো! ওহ হি ইজ এ ডেভিল! এ জায়ান্ট! এ গড! অ্যান্ড হোয়াট নট! আই কুড নট বিয়ার হিম!
সারার চেহারা যাই হোক মেক আপটি অদ্ভুত। চুলগুলো যোগিনীর মতো ঝুটি করে বাঁধা, গলায় বড় কালো গোটার মালা। কাঁধ অবধি কাটা নীলরঙের ব্লাউজ। বেগুনি রঙের সিল্কের শাড়ির আঁচলটা বুকে পেঁচিয়ে রেখেছেন কিন্তু এসব কিছু নয় আমি নেহাৎ কথা বলবার জন্যই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা যদি মনে কিছু না করেন আপনাদের বাড়ি কোথায়? দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ!
ইয়েস, ইউ আর রাইট। সারা মুখভঙ্গি করে বললেন, বাট আই হেট দ্যাট কান্ট্রি লাইফলেস এ ল্যান্ড অব মেয়ার মনটোনি। অ্যান আর্টিস্ট কান্ট লিভ দেয়ার, নেভার!
রায়হান মাঝখানে আমাকে চুপি-চুপি জিজ্ঞেস করল, টাকা পেয়েছিলে নাকি?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিই। আমেদ লক্ষ্য করছিল সে কটু করে বলল, তা হলে হয়ে যাক না এখনই?
মিস আহমদ আছেন সে ভালোই হয় কি বলিস? রায়হান আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
এরপর সারাও লক্ষ্য করেছে দেখে আমি বললাম, আপত্তি নেই। তবে ও জিনিস হবে না!
তোকে নিয়ে সত্যি মুশকিল! তাতে দোষটা কিসের?
ছবির টাকার সঙ্গে একটা পবিত্র স্মৃতি রয়েছে এদের কাছে বলতে যাওয়া অর্থহীন, তবু জানালাম, না ভাই তা হলে আমাকে মাফ করতে হবে।
ঠিক আছে অন্য জিনিসই খাব চ। প্লিজ কাম অন উইথ আস মিস আহমদ! রায়হান হাত বাড়িয়ে আপ্যায়ন করল।