আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?
মগপল্লীর দিকে। কাজ করতে এসেছি বসে থাকার জন্য নয়। ওর চেহারায় এমন দৃঢ়তা আমি না গেলে একাই যাবে। অগত্যা তৈরি হলাম।
নদীর পাড়ে ঘেঁষে নতুন শালবন এরপরে জঙ্গল এবং তার কাছাকাছি দিয়ে ছোট পাহাড়মালা। সীতাপাহাড়ের শাখাপ্রশাখা। পাহাড়ের ঢালুতে একটা মগপল্লী। আশপাশে জমিজিরাত কিছু আছে। বাড়িতে লাউ মাচান কলাবাগান। জুমিয়া মগেরা থাকে পাহাড়ের ওপরে মাচানের মতো উঁচু করে বাঁধা বাঁশের ঘরে কিন্তু সমতলে এরা জুমিয়া নয় দেশি লোকদের মতোই তাদের গিরস্তি ও ঘরসংসার। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি এখানে কোনো কোনো ঘর মাচানের মতো বাঁধা।
প্রকৃতি ও মানুষ সবকিছু ভালো লাগলেও একটা বিষয়ে আমার কৌতূহল বিশেষ জাগ্রত ছিল। তাই জিজ্ঞেস করলাম, তিনাদের বাড়ি কোথায়?
মুজতবা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে সংক্ষিপ্তভাবে জানাল, এখানে নয়।
আর কিছু বলল না যেন এ ব্যাপারে আর কিছু জানবার অধিকার আমার নেই।
একটা বাড়ির উঠানে পা দিতেই কুকুর ঘেউঘেউ করে ওঠে। একটা লোক বাইরে এল। তার পেছনে দুটি মেয়ে এবং ন্যাংটা বাচ্চা কয়েকটি। মুজতবা কাছে গিয়ে গেলাস ধরার ভঙ্গিতে হাতটা মুখের কাছে নিয়ে পানি চায়। লোকটা হাসল। এরপর দুটো পিঁড়ি পেতে দিল বারান্দায়। আমরা পরপর পানি খেলাম। কাছে ঠকর ঠকর আওয়াজ হচ্ছিল, গলা বাড়িয়ে দেখি কয়েকটি মেয়ে তাঁতে কাপড় বোনায় ব্যস্ত। উঠতে গেলে কলাবাগানের পথে কলসীকাঁখে এলো আরেকটি ডাগর কিশোরী।
এক বাড়িতে বসেই পাহাড়ের টিপিকাল জীবনের অনেকগুলো স্কেচ করে ফেললাম। ছবি দেখে ওদের কি স্ফূর্তি। চাইতেই নাপপি এনে দিল। নাকের কাছে নেওয়া যায় না-ওয়াক থো সে কি দুর্গন্ধ, ওদের প্রিয় খাবার!
কেউ বর্ণনা না করলেও ছবি আঁকতে আঁকতে আমার কল্পনায় ভাসছিল তিনার চেহারা। ঐ যে তাঁত বুনছে তারই মতো মিষ্টি মুখোনি। অষ্টাদশী যুবতী কিন্তু চোখমুখ এখন উদ্ভ্রান্ত, হাহা করে হাসছে শুধু।
রাত্রে খাওয়া দাওয়া শেষে বারান্দায় বসেছিলাম আমরা। আকাশে তারার ঝলক। নদীর ওপারে তেমনি অন্ধকার, আশপাশে তেমনি আবছায়া। সিগারেট টানছি কিন্তু কারো মুখে কথা নেই। হঠাৎ একটা ঢিল এসে পড়ল পাকার ওপর, ভাঙা ইটের টিল, বেশ বড়। আমরা চমকে উঠে দাঁড়াই। শাহাদৎ তীক্ষ্ণস্বরে জিজ্ঞেস করে উঠল, কে? কে ওখানে? সালামত! বন্দুক লে আও। জলদি!
সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের ঝাড় সশব্দে ভেঙে পড়ার মতো নারীকণ্ঠের একটা অট্টহাস্য হা হা হা হা, হি হি হি হি। শাহাদৎ বলল, এই যে তিনা।
তিনা! বিকারগ্রস্তের মতো উচ্চারণ করল মুজতবা।
শাহাদাৎ জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ, তিনা নিশ্চয়ই তিনা!
এবং তৎক্ষণাৎ বারান্দা থেকে একলাফে নেমে পড়ল মুজতবা । তিনার অট্টহাস্য দূরে সরে যাচ্ছিল, দুপদুপ পায়ে সে ছুটছে। খটাস্ করে গেটটা খুলে বেরিয়ে গেল। কি ঘটে যাচ্ছে একমুহূর্ত আমরা বিভ্রান্ত হতবাক। পর মুহূর্তে ঘোর কাটলে আমি বলে উঠলাম, সর্বনাশ মুজতবা যাচ্ছে! ও বিপদে পড়বে! চলো আমরা যাই পিছু পিছু! দেরি করো না চলো!
উত্তেজনায় কাঁপছিলাম কিন্তু শাহাদৎ নির্বিকার আমাকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত গম্ভীর স্বরে বলল, দরকার নেই। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দে! তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনি নিঝঝুম আকাশের তলে রাতের অন্ধকারে অরণ্যে নদীতে পাহাড়ে পাহাড়ে একটা ডাক ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে যাচ্ছে, তি-না!
১০. কত রাত হলো
কত রাত হলো? করাচীর লাল নীল সবুজ আলোকমালা ঝিমিয়ে এসেছে আর আমি জেগে আছি? আমি কি মাতাল হয়ে গেলাম?
না, মাতাল হইনি, তবে নেশাগ্রস্ত আছি বৈকি। এ নেশা এক অদ্ভুত নেশা, সব ভুলিয়ে রাখে। সত্তাকে ডুবিয়ে দেয়, ঢেকে রাখে তার মায়াবী আচ্ছাদনে। তিনবন্ধু রাতের অভিসার থেকে ফিরেছে কিনা জানিনে, জানবার ইচ্ছেও নেই। ইতিমধ্যে যদি এসেও থাকে সকাল আটটা নটা অবধি ঘুমাবে সে এক ভালোই। সে কোনো রকম ধাক্কাকে এড়িয়ে যাবার সুবিধে।
কিন্তু বাকি রাতটুকু আমিও যে দুচোখের পাতা এক করতে পারব না। মেঘের আবরণ ছিন্ন হয়েছে কিন্তু কুয়াশা এখনো কাটেনি। ছবি আর তিনা এক ছবিরই দুই রূপ একই শিল্পীর আঁকা, তাই শিল্পী মুজতবার ভারত ভ্রমণ হয়তো বৃথা যাবে না। সেদিন রাতেও আমার তাই মনে হয়েছিল। তাই হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলাম, পাহাড়ের ওপর থেকে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে কে আমাকে ডাকছে, হোঁচট খেয়ে খেয়ে প্রাণপণে উপরে উঠছি কাছাকাছি গিয়ে দেখি ছবি- ও হাত বাড়িয়ে দিল, আমি ধরতে যাচ্ছি এমন সময় পা পিছলে পড়ে গেলাম একেবারে গভীর খাদে। চিৎকার করে জেগে উঠেছিলাম, সর্বাঙ্গ ঘামে ভেজা। একটা গোপন ভয় এসে মনে বাসা বাঁধল। এতে কাছে পেয়ে এমনি করেই তো আমরা হারাই?
এখানকার কাজ সেরে রাঙামাটি যাওয়ার প্ল্যান ছিল। কিন্তু সব বাতিল করে দুদিন পরে আমি চলে এসেছিলাম।
ছবি আমাকে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দেখে অবাক হয়েছিল। কিন্তু আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে বুকে চেপে বললাম, তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি তাই ছুটে এলাম। তোমার কিছু হয়নি তো?
না না। ওগো কিচ্ছু হয়নি, তোমার কথাই ভাবি শুধু, কিছু হবে কেন?
এবারও করাচীতে সাতদিন থাকার কথা কিন্তু চারদিনের দিন ফিরে গেলেও ছবি এবারে বিস্মিত হবে না। বরং বলবে এ-তো দিন! বড় শহরে গিয়ে আমাকে ভুলে গিয়েছিলে বুঝি? এত দেরি হলো!