শাহাদাৎ বাংলোতে ঢুকে মুজতবাকে দেখেই বলল, এলেই শেষ পর্যন্ত। বেশ, ইটস্ ওক্যা। আমার ঝক্কি একটু বাড়লো আর কি। তুমি আবার কিছু মনে করো না জাহেদ, একটা পার্সোনাল ব্যাপার আছে। মাজু! মাজু!
চিলের ডাকের মতো সাহেবের চিৎকার শুনে মাজু মিঞা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। বলল, জি সাব।
তোমার বাজার-সওদা ঠিক আছে তো? দুই সাহেব এসেছেন।
সব আছে, স্যার। তবে কিছু হলদি গরম-মশলা আর পান সুপারি আনতে অইব। আজগা মুর্গিই ধইরা ফালাই।
মাজু মিঞাকে বিদায় দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে শাহাদাৎ জিজ্ঞেস করল, তারপর? তোমার খবর কি, জাহেদ? শুনলাম বিয়ে করেছ!
আমার বিয়ের খবর এই জঙ্গলে পর্যন্ত এসে গেছে! আশ্চর্য।
আশ্চর্য কিছু নয়, তোমরা হলে গিয়ে এখন বিখ্যাত লোক।
ঢাকায় গিয়েছিলে নাকি?
আরে না গেলেও সব খবর পাই। এই শ্রীমানই লিখেছিল। বলে মুজতবার দিকে বা হাতের বুড়ো আঙুলটা নির্দেশ করল।
দু’বছর আগে মুজতবা একবার এসে এখানে মাসখানেক কাটিয়ে গেছে জানি; কিন্তুই তবু এমন বিমর্ষ হয়ে থাকার কোনো মানে বুঝতে পারছি না। সে চুপচাপ ধূমপান করছে।
গত রাতটা কেটেছে ট্রেনে কাজেই কিছু ঢুলেছি শুধু, ঘুমাতে পারিনি। দিনের বেলাতেও তা পুষিয়ে নেবার সুযোগ ছিলো না। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার আগেই চোখ জড়িয়ে আসছিল; কিন্তু ক্ষিদের মার ভয়ানক। ভালো রান্না, গলা ইস্তক পুরে নেওয়া গেল। বারান্দায় ওদের সঙ্গে বসে একটা সিগারেট শেষ করার পর চলে এলাম। বিছানায়।
কিন্তু বসেই থাকে ওরা দু’জন। পাহাড়ি রাত, কৃষ্ণপক্ষের খণ্ডচাঁদ শালবনের ওপরে দেখা দেয় শেষরাত্রে; কিন্তু এখন অন্ধকার। বাংলোর আশপাশে পোকা-মাকড়ের রিঝি ঝিঁঝি একটানা সঙ্গীত এবং মগপল্লীতে মাঝে মাঝে কুকুরের ঘেউঘেউ। এছাড়া আর বিশেষ কোনো শব্দ নেই।
আমার চৌকিটা জানালার সঙ্গেই, কাজেই ওদের দুজনকেই দেখতে পাচ্ছি আবছা মতো। দু’টি সিগারেটের দুই বিন্দু আগুন। দু’জনেই নীরব রইল খানিকক্ষণ। এরপর শাহাদাৎ নিচুস্বরে বলল, এত করে মানা করলাম, তুই না এলেই পারতিস্ মুজতবা । এখানে তো তোর নতুন কিছু করার নেই। যা হবার হয়ে গেছে, আবার ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি।
আমি চোখ বুজে আছি কিন্তু কানখাড়া। মুজতবা বেতের চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। পরে বলল, লাভ-লোকসান আমি বুঝি না। কেবল না এসে ভালো লাগছিল না একথা ঠিক। বিপদ আর কি হবে, মৃত্যুর ওপরে তো কিছু নেই? জীবন আর মৃত্যু আমার কাছে সমান। আর জীবনকে দেখার জন্য যে মৃত্যু তা’তো অভিনন্দনযোগ্য।
বড় কথা রাখ্। তুই যা করেছি তা কিন্তু কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না। আমি হলে তো গুলী করে মারতাম। ছাইলাউংকা তোকে খুঁজছে নানা জায়গায়, এখানেও এসেছে কয়েকদিন। পেয়ে গেলে প্রতিশোধ নিতে ছাড়বে না। জংলি মানুষ, খুব সাংঘাতিক, ক্ষেপলে খতম না করে শান্ত হয় না। বিশেষ এখানে জীবন নিয়ে খেলা। ওর একমাত্র মেয়ে তিনা, তাকে তুই নষ্ট করেছি।
আমি তো নষ্ট করিনি? সে তো ইচ্ছে করেই ধরা দিয়েছিল।
হ্যাঁ। কিন্তু ওরা ইচ্ছে করে ধরা দেয় কখন? যখন একজনকে ভালোবাসে। তার মানে হলো, চুংমুংলে’র সুমুখে এক শুকর তিন মুর্গি বলি না দিলেও সে তাকে স্বামী হিসেবেই ভাবে। কিন্তু তুই তো পালিয়ে গেলি? এ নিছক ধাপ্পা। তিনা তোকে মনপ্রাণ দিয়েই ভালোবেসেছিল, তাই না পাগল হয়ে গেল। এ অঞ্চলের কে না জানে। মহা কেলেঙ্কারি। আধ পাগল অবস্থায় ছেলে হলো ওর এবং যে ক’দিন শিশুটি জীবিত ছিল একদম ভালো। ও যেন সব ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু একদিনের জ্বরে ছেলেটা মারা যাওয়ার পর থেকে এখন বদ্ধ পাগল। গুনগুন্ করে গান গায় আর পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। কয়দিন রাত্রে এখানে এসেছে। চিলড়ে বড় উৎপাত করে।
আবার অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ। এক সময় বহুদূর থেকে যেন মুজতবার ম্লানস্বর বেরিয়ে এলো, অনেক খারাপ কাজ করেছি; কিন্তু এভাবে কোথাও ধরা পড়িনি!
ধরা লোকে একবারই পড়ে তাই হয়তো! কি আছে, একটু সাবধানে থাকতে হবে আর কি! চল্, শুয়ে পড়া যাক! শাহাদাৎ উঠতেই শোনে গেটে কিকি করে একটা শব্দ হলো, ছায়ামূর্তির মতো একটা লোক ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে। সে তৎক্ষণাৎ তির্যকস্বরে প্রশ্ন করে উঠল, কে? কে ওখানে?
মুজতবা বলল, ব্যাপার কি!
সেদিকে কান না দিয়ে শাহাদাৎ ডাকল, সালামত! সালামত! আমার বন্দুকটা নিয়ে আয় জলদি!
আমি উঠে কখন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি বলতে পারবো না। বন্দুকের কথা শোনামাত্র আবার কিকি শব্দ। এবার দ্রুত। আমরা দেখি একটা লোক সত্যি বাইরে বেরিয়ে গেল। বন্দুক আর টর্চ নিয়ে এসে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও আর পাত্তা মিললো না তার।
আমার হৃৎপিণ্ডটা ঢিবৃঢ়ি করছে! এই নির্জন এলাকায় সবকিছুই ঘটা সম্ভব।
মুজতবা আস্তে আস্তে বলল, আমার মনে হয় ছাইলাউংফা। আসবার সময় মগবাজারে আমাদের দেখছিল!
তাই নাকি? শাহাদাৎ বলল, তাহলে সত্যি বিপদ।
এত ভয় পাবার কি আছে! বেশি বাড়াবাড়ি করলে জানটা হারাবে। মুজতবার কণ্ঠস্বরে একটা অশ্লীল হিংস্র উল্লাসের রেশ। সবদিক ভেবেচিন্তেই সে এখানে এসেছে।
রাত্রে পাহারার ব্যবস্থা করা হল! খানিকটা নিশ্চিন্ত থাকায় আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঈষৎ কুয়াশার আমেজ, সকালটা সত্যিই মধুর। সালামত বলল ছায়ামূর্তির মতো একটা লোক দুতিনবার প্রাঙ্গণে ঢুকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু বন্দুকের নল দেখে সাহস পায়নি। চা খাওয়ার পর মুজতবা বলল, চল বেরিয়ে পড়ি!