কাছাকাছিই বসেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার হে! রাধারানির সঙ্গে ঝগড়া করে এলে নাকি?
আরে ছছাঃ রাধারানি! মুজতবা চরম তাচ্ছিল্যব্যঞ্জক একটা মুখভঙ্গি করে চুপ মেরে গেল। মাথা একটু তুলে বলল, জানিস্ জাহেদ জীবনটাকে আমার মনে হয় একেবারে অর্থহীন অ্যাবসার্ড। ইটস এ টেল টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট ফুল অব সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি অ্যান্ড সিগনিফায়িং নাথিং!
হঠা–ৎ! আমি জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকাই।
হঠাৎ নয়! এটাই আমার বরাবরের মনোভাব। গোটা জিনিসটাই যখন নিরর্থক তখন একে নিয়ে এতো ভাবনার কি আছে। যা হবার হবে। ভালোভাবেই হোক আর মন্দভাবেই হোক গন্তব্য সেই একই ধ্বংস মৃত্যু বিলুপ্তি!
এযে দেখছি অন্যরূপ, অথবা এই সর্বাত্মক আস্থাহীনতাই কি ওর উচ্ছল জীবনযাত্রার উৎস?
কিন্তু মাথায় রোদ, এখন কিছু চিন্তা করবার সময় নয়; সাম্পানটা পাড়ে এসে লাগলে আমরা উঠে পড়ি। আড়াইটে বাজছে, খাওয়া দাওয়া শেষ? এখন ছবি বিছানায় কাত হয়ে নিশ্চয়ই ভাবছে আমার কথা। আরে হ্যাঁ ও বারবার মিনতি করে বলেছিল পৌঁছেই একটা চিঠি দিতে, চট্টগ্রামে সেকথা মনেই হয়নি। এখান থেকে লিখতে হবে। ও আদর করতে করতে আরো বলেছিল ঠিক সময়ে খেয়ো ঠিক সময়ে ঘুমিও যেন। শরীরটা একটু এদিক-সেদিক হলে দেখা যাবে!
আমার শরীরটা ছবির সম্পত্তি এবং যতটুকু তার জৌলুস তা গত কয় মাসে ওরই হাতে গড়া। কাজেই বললাম তোমার জিনিস আমি নষ্ট করবো পাগল!
কিন্তু ওটা ছিল কথার কথামাত্র। কারণ শুধু আমি নয় ও নিজেও জানত যে-কাজে বেরুচ্ছি তাতে সমায়ানুবর্তিতা অসম্ভব।
ওপরে উঠতেই দেখি ছোট্ট বাজার। একধারে দাঁড়ালে অন্য প্রান্তটুকু পর্যন্ত দেখা যায়। বাঁশের চালাঘর আছে কয়েকটা, মাঝখানে একটি বটগাছ। পুরোপুরি বিকেল হয়নি তবু জায়গাটা লোকজনে ঠাসা। পরে জানতে পেরেছি সকাল থেকেই বাজার বসে এবং সন্ধ্যার ঘণ্টাখানেক আগে শেষ হয়ে যায়। এরপরে যারা থাকে তারা একান্ত কাছের বাসিন্দা। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি। রোজকার দরকারি জিনিসপত্র। ধানচাল তরিতরকারি তাঁতেবোনা কাপড়চোপড় এলুমিনিয়ামের তৈরি সস্তা অলঙ্কার। পাইপ তামাক বাঁশের চোঙের দই চুরুট কিন্তু নতুন যা চোখ পড়লে সে হলো পুরুষের চাইতে মেয়ের সংখ্যা কম নয়। পরনে নকশি কাজ করা শাড়ি বুকে বাঁধা একখণ্ড চিত্রিত কাপড় গোলগাল স্বাস্থ্যবান চেহারার তরুণীরাও নিরুদ্বেগে জিনিস নিয়ে বসে আছে। কেউ কেউ কিনছে জিনিস। পাঁচ ছমাইল দূর থেকে যারা আসে তারা বেচাকেনা করার পর বাঁশের ঝাপিটা পিঠে বেঁধে ফিরে চলেছে।
বটগাছের একটা শিকড়ের কাছে তিনটে মেয়ে বসে ছিল। এদের একটি বেশ সুন্দরী। কাটা চেহারা। ওদের সামনে হাতের তৈরি চুরুট।
মুজতবা কাছে গিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে আধা চাঁটগাই আধা হিন্দি ভাষায় আলাপ শুরু করে। ওরা সব বুঝেছে এমন নয় তবু উত্তরও দিচ্ছে। প্রত্যেকের মুখেই নিরীহ সরল হাসি।
মুজতবা তুলি কাগজ দেখিয়ে ওর অদ্ভুত ভাষায় জিজ্ঞেস করল, ছবি আঁকলে ওদের আপত্তি আছে কিনা। সেজন্য রুপেয় বখশিস দিতেও সে রাজি।
তিনজনের মধ্যে সবার বড় গোলগাল মেয়েটি আভাস ইঙ্গিতে জবাব দিল, এখানে সম্ভব নয় বাড়িতে গেলে রাজি হতে পারে।
ওরা যখন আলাপ করছিল আমি মুখ তুলতেই দেখি লুঙিপরা গায়ে জামা মাঝবয়েসী একটা মগ কিছুদূরে দাঁড়িয়ে বুলডগের মতো তাকিয়ে আছে। সে কে? এমন ভাব কেন? ছোট ছোট চোখ যেন জ্বলছে একেকবার। ভাবি এমনভাবে আলাপ করছে বলেই হয়তো! মুজতবাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকলাম, এই! আর কত ওঠ না?
কেন হয়েছে কি? বলে মুখটা তুলতেই ওর দৃষ্টিও পড়ল গিয়ে লোকটার দিকে। এবারে লোকটার ঠোঁটমুখ কাঁপছে যেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে! মুজতবার চেহারা নিমেষে ছাইবর্ণ। সে তাড়াতাড়ি উঠে বলল, চল্।
সবজিবাহী তিনমাঝির একটি লম্বাটে নৌকো কাপ্তাই যাচ্ছিল, এক কথায় দু’টাকায় রফা করে উঠে পড়া গেল। নৌকো দুইদাঁড়ের টানে এগিয়ে চলেছে। নদীর দুই পাড়ে ঝোঁপঝাড় কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই। আমি ভাবছিলাম অন্য বিষয়। ব্যাপারটা কেমন রহস্যময় ঠেকছে। যতক্ষণ না নৌকাটা ঝাঁপসা হয়ে আসে ততক্ষণ নড়েনি। মুজতবাকে একবার মাত্র জিজ্ঞেস করলাম, কিহে কি ব্যাপার!
সে অন্যমনস্কভাবে বলল, কিছু না, ছাইলাউংফা মগ!
আমি আরো কিছু জানতে চাইলাম কিন্তু ওর চেহারা দেখে দমে যাই। কেমন কঠিন আর কালো। সে আমার পরিচিত সঙ্গীটি যেন নয়।
কাপ্তাই খালের কাছাকাছি বনবিভাগের বাংলোতে যখন এসে পৌঁছি তখন সন্ধ্যে হওয়ার সামান্য বাকি। একটা ঘরে জিনিসপত্রগুলো রাখার পর মুজতবা চৌকিতে শুয়ে পড়ল। আমিও একটা ইজিচেয়ারে কাত হলাম। সকাল থেকে এতটুকু বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া যায়নি।
কাছেই কোথায় ছিল নিম দাড়িওয়ালা বাবুর্চি মাজু মিঞা, এসেই অবাক হয়ে গেল, স্যার যে! কখন আইলেন?
মুজতবা মাথাটু একটু তুলে জিজ্ঞেস করল, এই তো এক্ষুণি! তোমার সায়েব কোথায়?
জঙ্গলে গেছেন! মাজু মিঞা বলল, আওনের সময় অইছে।
ভালো আছ তো সব? এবার সে উঠে বসে পকেট থেকে প্যাকেটা বার করে একটা সিগারেট ধরালো।
সিগারেটটা পুড়ে অর্ধেক না হতেই শাহাদাঁতের গলা শোনা গেল। তার পায়ে বুট পরনে হাফপ্যান্ট কাঁধে বন্দুক এবং সামনে পিওন পেছনে দারোয়ান। বেঁটে খাটো ছেলেটি কিন্তু নাকি দাপট প্রচণ্ড। সহকারী বন অফিসার হলেও কি হবে এই জবরদস্ত লোকগুলোও বড় অফিসারের চেয়ে তাকে ভয় করে বেশি, প্রায় যমের মতো।