রাস্তার ধারে প্রাসাদোপম বিরাট বাড়ি। আজ গিয়ে দেখা দিলে জোবেদা খালা ভীষণ খুশি হলেন। আদর করে বললেন, এসেছিস ভালোই হলো। আজ আমরা বেড়াতে যাচ্ছি, ম্যানোরায়। তুইও চল।
বললাম, নিশ্চয়ই যাব, অবশ্যি যদি আপনাদের কোনো অসুবিধে না হয়।
অসুবিধে? কি যে বলিস। যত লোক হয় ততই ভালো। তাছাড়া এই প্রথম এলি করাচী, আমাদের কিছু করার আছে তো? বৌমাকে নিয়ে এলেই পারতিস? বাচ্চাটা কেমন হয়েছে রে?
খালা কথা বলতে শুরু করলে থামতে চান না। উপরন্তু অনেকদিন পর পেয়েছেন দেশের লোক।
দেখতে খারাপ হয় নি। তবে স্বাস্থ্যটা খুব ভালো যায় না। বাচ্চার প্রসঙ্গ ছেড়ে আমি নিচু স্বরে বললাম, খালা, আমার মাদার আর্থ ছবিটা একজিবিশনে ফার্স্ট হলো!
তাই নাকি, এতবড় খবরটা তুই এতক্ষণ চেপে রাখলি? ঘাড়ে গর্দানে মুটিয়ে যাওয়া খালা ভয়ানক ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ইয়ারিং দুলছে। প্রসাধন-বিশুদ্ধ শক্ত চামড়ার গালেও পড়ছে টোল। উচ্ছ্বসিত নানা প্রশ্নের উচ্চারণে মুখের কোণে ফেনা দেখা দিল।
তাঁর উল্লাসটা আন্তরিক, শিল্পসাহিত্যের প্রতি বরাবরই আকর্ষণ ছিল, মাঝে মাঝে লিখেও থাকেন। বড়লোকের বৌ, শখ প্রচুর; কিন্তু এ ধরনের শখ ক’জনের থাকে?
এখানে আসবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও করাচীকে মনে হয়েছিল শুকনো, হৃদয়হীন, রাতজাগা ধনী লম্পটের মতো। হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, দু’দিনেই। এতক্ষণে একটু সহজ হলাম। গুনগুন গান জমে ঠোঁটের কোণায়। বাড়িটা সত্যি চমৎকার। আধুনিক স্থাপত্য রীতিতে তৈরি। ত্রিকোণ সিঁড়ি-বারান্দা, দেয়ালে গাঁথা ফিতের মতো ফুলের চাতাল। অবশ্য নকল মুক্তোর মতো, তবু রুচির ছাপ তো আছে খানিকটা? এটুকুতেই আমি খুশি। বাথরুমের টবে ঈষৎ গরম পানিতে অনেকক্ষণ ধরে গা ডুবিয়ে গোসল করার পর খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম নিই। মানুষ ও খাদ্যদ্রব্যে গাড়ি বোঝাই, আড়াইটার সময় বেরিয়ে পড়লাম। খালার ছোট দুটো মেয়ে, মেকানিক ও ড্রাইভারসহ আমরা ছয়জন। তাছাড়া এক বাঙালি নব-দম্পতি এসেছেন। ঠাসাঠাসি করে বসেছি; তবু সকলের চোখেমুখেই স্থূর্তির দীপ্তি, হালকা হাওয়ায় পালক মেলে উড়ে বেড়াতে কোনো ক্লান্তি নেই।
নীল আকাশ, তক্তকে রাস্তা, হরেক রকম মুখের সমারোহ, পৃথিবীটা সত্যি সুন্দর। গাড়ির শব্দের সঙ্গে ডুবিয়ে দুটি কলি গাই বারবার, কান্নাহাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা, তারি মধ্যে চিরদিনের বইব গানের ডালা।
গাইছি বটে, কিন্তু ভাবছি অন্যকিছু। স্বামী বাইরে গেছেন, অথচ জোবেদা খালা নিজেকে নিয়ে বেশ আছেন, এই সূত্র থেকে চিন্তাটা ক্রমে বিস্তারিত হতে থাকে, বেগুনি মেঘের মতো। আসলে তার জীবনটাই তো বর্ণময়। ছোটবেলায় দেশের বাড়িতে দেখেছি দু’একবার, শাদামাটা বোকা বোকা চেহারা। টেনে টেনে কথা বলতেন। একটা সরল স্নিগ্ধ সৌন্দর্য ছিল তাঁর চলনে বলনে কাপড়ে জেওরে সর্বত্র। স্কুল-মাস্টার বাবা তাঁকে স্কুল-মাস্টারের হাতেই সঁপে দিয়েছিলেন কিনা। ছেলেটা আদর্শবাদী, দেশের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বাবা খুবই স্নেহ করতেন, নিজের ছেলেদের চেয়ে বড়ো।
তাঁর নিজের ছেলেরা কলকাতায় গিয়ে তখন উন্নতির জন্য উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিল। একজন এক কুখ্যাত হোটেলে চাকরি নেয়, দ্বিতীয়জন খোলে মদের দোকান।
সেই সূত্রেই সাহেবের সঙ্গে পরিচয়। ভাবির সঙ্গে কলকাতায় বেড়াতে গেলে জোবেদা খালার সঙ্গেও ভদ্রলোকের পরিচয় হয়েছিল।
উনি ডাকসাইটে মার্চেন্টই শুধু নন, পাক্কা মুসলমান। ভারতের প্রত্যেক বড় শহরেই যেমন তাঁর অফিস তেমনি মাদ্রাজ, বোম্বাই, এলাহাবাদ তিন জায়গায় তিন বিবি। প্রত্যেককেই বাড়ি করে দিয়েছেন এবং মাসোহারা নির্দিষ্ট। এক একজনের কাছে এক এক মাস থাকেন, প্রতি তিনমাস অন্তর পালাবদল। কলকাতায় এমন ব্যবস্থা ছিল না, সে জন্য অসুবিধে হতো এবং পরহেজগার হিসেবে সুন্নতও পুরা করতে চাইলেন।
স্কুল-মাস্টার আহাদের ইচ্ছা ছিল না বৌকে তালাক দেন; বরং ভাইয়ের প্ররোচনায় তার পদস্খলন হওয়া সত্ত্বেও ফিরিয়ে আনতেই গিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়ে দেখেন, জোবেদা সম্ভ্রান্ত মহিলা। প্রকাণ্ড পাকা বাড়িতে থাকেন। গেটে বিহারি দারোয়ান, চাকর চাকরানী প্রচুর।
একটা পিস্তল জোগাড়ের চেষ্টা করেছিলেন কয়েকদিন; কিন্তু শেষে এমনিতেই ফিরে এসেছিলেন। এরপর আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।
গান কখন থেমে গিয়েছিল খেয়াল নেই, হঠাৎ খালার কণ্ঠস্বর কানে গেল, কি জাহেদ! চুপ হয়ে আছি যে, কেমন লাগছে কিছু বল্।
বেশ ভালো! আমি হেসে বললাম, ক্লিফটন আর ম্যানোরা বুঝি আরও সুন্দর?
হ্যাঁ। খালা বললেন, তবে ক্লিফটন আমার ভালো লাগে না, আউটিং এর জন্য ম্যানোরাই বেস্ট। আর চেঞ্জের জন্য হবে। সেখানে অনেকগুলো কটেজ হয়েছে। ওদিকে যেতে চাও নাকি?
আমার কোথাও যেতে আপত্তি নেই, দেখতেই এসেছি। তাছাড়া নতুন জায়গা মাত্রই আমার প্রিয়।
বেশ যাওয়া যাবে আর একদিন। কটেজ ভাড়া করে একদিন একরাত্রি ওখানে কাটানো যাবে।
আমি চুপ হয়ে থাকি। ভাবছিলাম, জীবন পদার্থটা আশ্চর্যরকম স্থিতিস্থাপক; যে কোনো অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারদর্শী। সে যতই নিষ্ঠুর হোক না কিংবা অনাত্মীয়। সে খোলস ছাড়ে খোলস বদলায়। নতুন নতুন আচ্ছাদনে হয় চঞ্চকে বিচিত্রিত। আবার চরম ভাগ্যের সময়েও হারিয়ে যায় না, মরতে মরতে বাঁচে। ধুঁকতে ধুঁকতে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সরাসরি। সে মরে না, কারণ বেঁচে থাকাই তার ধর্ম।