রিকশা করে ও আমাকে যেখানে নিয়ে এলো সে জাহাজ ঘাট। একটু পরেই লঞ্চ ছাড়বে। লোকজন সব উঠে পড়েছে। যাত্রার আগে সারেং কষে ভেঁপু বাজাচ্ছিল, এটা লোক ছুটিয়ে আনার কায়দা। স্টিমে চললে কি হবে এও কেরায়া নৌকা বৈ তো নয়! খ্যাপ পোষানো চাই।
আমরা দু’জন পিছিয়ে পড়ার দলে কিন্তু মুজতবা তবু যাচ্ছে গদাই লস্করি চালে, কোনো তাড়া নেই। আমি বললাম, আর একটু তাড়াতাড়ি যাওনা। লঞ্চ ছেড়ে দেবে।
ছাড়বে না, ও নিরুদ্বিগ্নস্বরে বলল, আরো অন্তত আধঘণ্টা দেরি!
ও এ বিষয়ে অভিজ্ঞ, কাজেই আর উচ্চবাচ্য করা অনুচিত। আমি চুপ মেরে গেলাম।
সাম্পান ভাড়া, জাহাজ পর্যন্ত গেলে ও দুটি আনি বাতার ওপরে রেখে দিল। মাঝি পয়সাগুলো দেখেই কাইকাই করতে থাকে বলে আট আনার এক পয়সা কমও নেবে না। কিন্তু ও নির্বিকার। জিনিসপত্রগুলো রেখে আরেকটি দু’আনি ছুঁড়ে মারলো, বলল ওডা! এ তরে বখশিস দিলাম।
মাঝি রাগ চাপতে চাপতে সাম্পান ঘোরায়। মুজতবা বলল, এরা এমনি। দু’জনের একআনা হলো আসল ভাড়া। কিন্তু বাইরের লোক ভেবেছে ব্যস যত পারো আদায় করো। বড় বাজে!
লঞ্চ ছাড়ল আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর। কড়া রোদ ছিল না। আমরা ছাদের ওপর গিয়ে বসে সিগারেট ধরাই। দূরে পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে বেগুনি মেঘের মতো। আর নিচে দুই তীরে সবুজের পোচ নিয়ে ঘুরে বেঁকে চলে এসেছে নদীটি নাম যার কর্ণফুলী, পাহাড়ি মেয়েদেরই মতো পায়ে নূপুর।
প্রকৃতির পটে আঁকা বিধাতা শিল্পীর আশ্চর্য চিত্র, ওর তুলনা কোথায়? বাইরে ছবি, ভেতরে গান এবং এই তো জগৎ। মুজতবা একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। সে বরাবর গম্ভীর হয়েই আছে। বলল, চেয়ে দ্যাখ জাহেদ! বেশ লাগছে, আঁকবি নাকি?
হ্যাঁ আঁকলে হয়, রং তুলি নিয়ে আসি। আমি উঠে নিচে নেমে এলাম। আর একটু দেরি না করে সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে আবার ওপরে উঠি।
রং গুলে নিয়ে দু জনেই কাজ করছি, ওয়াটারকালার। ও আঁকছে দিগন্তরেখা আর নদী, আমি একজোট নৌকা।
আঁকছি বটে তবে খুব একটা উৎসাহ নেই। ল্যান্ডস্কেপ আমার ভালোই হতো কয়েকটি কাজ বহুল প্রশংসিত হয়েছে কিন্তু সেগুলোও যেন আনাড়ির চিত্রচর্চা। কাঁচা রং নিয়ে খেলা! কেন জানি এসব আর ভালো লাগে না, ভালো লাগে না মোটেই। মানববিরহিত প্রকৃতি যেন অর্থহীন অনাবশ্যক। শিল্পের বিষয় হিসেবে আমি মানুষকে চাই, কেবল মানুষ। পাহাড়কে আমি পছন্দ করি! কিন্তু শুধু পাহাড়ের দৃশ্যচিত্র আঁকার কি সার্থকতা আছে বুঝিনা সেজন্য গোড়া থেকেই আমার লক্ষ্য পাহাড়ি মানুষ। গর্গার মতো পলায়ন নয় কিন্তু তাহিতি আমার চাই আদিম তাহিতি।
ব্রাশে তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করে জিনিস গুটিয়ে ফেলি। মুজতবা জিজ্ঞেস করল, কিরে শেষ হয়ে গেল?
হ্যাঁ। সংক্ষিপ্ত জবাবটুকুর পরে ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরালাম। রঙের হিজিবিজি রেখায় ভরে গেছে ওর কাগজটা, খুব একটা ইচ্ছা নিয়ে যেন আঁকছে না ও। আমি জিজ্ঞেস করলাম, চন্দ্রঘোনায় পৌঁছতে একটা বাজবে?
লঞ্চ এইভাবে চলতে থাকলে দেড়টা দুটোর মধ্যে নিশ্চয়ই।
আচ্ছা মগদের বাজার বসবে বলছিলে না তুমি? ঠিকই বসবে তো?
হ্যাঁ আজ শুক্রবার নিশ্চয়ই বসবে। তোর খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?
তা বৈকি। এজন্যই তো এলাম আমি, আবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বাইরের লোকদের ওরা কি চোখে দেখে?
যা স্বাভাবিক ঠিক সেই চোখে। খুব অতিথিপরায়ণ ওরা যদিও মগের মুল্লুক বলে প্রবাদ আছে, কিছুকাল আগেও যে কেউ গেলে খুব খাতির করত। কিন্তু আজকাল এতটা করে না। বেশি মাখামাখি করতে গেলেই সন্দেহের চোখে দেখে। বাইরের লোক গিয়ে ওদের বহু মেয়েছেলে নষ্ট করেছে কিনা?
কথাটা বলার পর ওকি যেন ভাবে, আমিও চুপ হয়ে থাকি। তাহলে পাহাড়ে বাস করলেও আদিম ওরা নয়। সভ্যতার আলোও পাচ্ছে প্রতিনিয়তই, আর এখন যখন এলাকাটাই কলের হুহুস্ আর ক্যাটারপিলারের চিৎকারে মুখরিত তখন আরো আলো পাবে বৈকি! কিন্তু না, বিচার করলে দেখা যাবে বর্বরযুগের বাস করবার চেয়ে সেও ভালো।
লঞ্চ চন্দ্রঘোনায় এসে পৌঁছল ঠিক পৌনে দুটোয়। পাড়ের দিকে ভিড়লে কিছু লোক সাম্পানে উঠে নেমে গেল, কিন্তু রইল বেশির ভাগ। তারা কাপ্তাইয়ের যাত্রী। আমি চেয়েছিলাম পেপারমিলের দিকে; পাহাড়ের বুনো এলাকায় সিংহ ব্যাঘের বদলে আজ যন্ত্রের গর্জন। প্রচণ্ড শব্দে বাঁশ কাটা পড়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এদিকে একটা পাইপ দিয়ে ব্যবহৃত ময়লা পানি পড়ছে সরসর ধারায় আর তারই রাসায়নিক অংশ সাদা ফেনা ভাসছে নদীর বুকে।
রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি, মুজতবা জিজ্ঞেস করল, মিলে নামবি নাকি?
আমি আর কি বলবো। তুমি যা ভালো মনে করো।
দেখতে দেখতে কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাবে। বাজার ভাঙে তার আগেই। এক সপ্তাহের আগে আর দেখতে পাবি না।
আমি বললাম, তাহলে থাক্ বাজারটাই দেখি। অন্যদিন সুযোগ করে মিলটা দেখে নেব।
ঠিক আছে তবে তাই হোক। একটি সাম্পান ভিড়েছিল আমরা জিনিসপত্র নিয়ে তাতে উঠে পড়ি।
ওপারে নদীর ধারেই মগবাজার। সকাল থেকেই লক্ষ্য করছি মুজতবার মুখটাকে দেখাচ্ছে বেশ কালো আর বিমর্ষ, কথা বলছে ঠিকই কাজও করছে কিন্তু ভেতরে যেন অন্য চিন্তা! তিক্ত কিছু গভীর কিছু। সাম্পানের পেছনদিকে বসে এখনো সে মাথাটা নিচু করে আছে।