কিন্তু তবু প্রেমহীন ফলের ক্ষেত্রেও মাতৃত্ব অপরাজেয়। আচ্ছা, ছবির সেই অচেতন আকুতিটিকে রেখার বাঁধনে ধরে রাখা যায় না? আলোর ঝিলিমিলির মতো একটা অস্পষ্ট চিত্র ধারণায় খেলতে থাকে।
বিষয়টা পুরনো। রাফায়েল কার্লো ডলচি মাইকেল এঞ্জেলো পিকাসো ডালি কেউ বাদ দেননি। বক্তব্যের বিশেষ পার্থক্য নেই আছে শুধু আঁকার স্বাতন্ত্র। প্রাচীনে ছিল কুমারী জননী ও শিশু এবং আধুনিকে যে কোনো অবয়বের কতকটা বিমূর্ত প্রতিরূপ।
চিত্রকলার পিতাদের ছবির সঙ্গে আরো একটি ছবি বাড়ালে আপত্তির তো কিছু নেই। ভালো হলে পুনরাবৃত্তি বলে হবে না পরিত্যাজ্য।
কিন্তু এখনই তা আঁকতে পারব না। ছবির কোলে অন্যের শিশু বসিয়ে কাজ করা যেতে পারে না এমন নয় কিন্তু সেটা সত্যিকারের কাজ হবে কি? তাতে আসবে কি মাতৃত্বের সেই গভীর মোহন রূপ? হয়তো তা নয়। ফুটতে পারে কিন্তু আত্মা জাগবে না এবং আত্মা না জাগলে তার প্রতিচ্ছায়াও পড়বে না মুখের রেখায় রেখায়। অপরপক্ষে নিজের বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে যে শিশু তৈরি হচ্ছে যে আসছে অনেক কালের আশা ও স্বপ্নের মতো সে-ই হতে পারে সত্যিকারের প্রেরণা।
ওর বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত এই ছবির কাজ স্থগিত রাখব বলেই ঠিক করলাম।
কিন্তু পর্যবেক্ষণ আমার থামল না। মাঝে মাঝে একদৃষ্টে চেয়ে থাকি। সেই দৃষ্টি অন্যের কাছে অস্বাভাবিক মনে হওয়াও স্বাভাবিক।
ছবিও একদিন বলল, কি ব্যাপার! এমন করে দেখছ যে আমাকে যেন অপরিচিতা!
আমি হেসে বললাম, পরিচয় আর কতটা হলো ছবি! আরো ভালো করে চিনতে হবে। এমনকি সারাজীবনই লাগতে পারে!
আরে বাপ! দেখি সাংঘাতিক ব্যাপার! আমাকে নিয়ে এত কি! আমি একটি সাধারণ মেয়ে মাত্র!
সাধারণ বলেই তো অসাধারণ! অসাধারণ যারা অসাধারণ হয়েই শেষ। কিন্তু সাধারণের মধ্যে সারাজগৎ।
ছবি কাছে এসে জড়িয়ে মাথার চুলে আদর করে আমার। গালে গাল চেপে রাখে। বলে, সত্যি তুমি এমনভাবে কথা বলো তা শুনে আমার কান্না আসতে চায়! অনেক দিলে আমাকে অ-নে-ক! প্রতিদানে কিছুই তো দিতে পারিনি আমি!
তুমি আমাকে কি দিয়েছ সে তুমি জানো না। আস্তে আস্তে বললাম, আমার জীবনে তোমার দান অপরিসীম এবং একথা বলছি তোমাকে খুশি করবার জন্য নয়! এ আমার প্রাণের সংলাপ!
ছবি বলল, সত্যি কি যে হলো আমার এক মুহূর্ত তোমাকে না দেখলে ভালো লাগে । তুমি কাজে যাও, আমি সারাক্ষণ তোমার কথাই ভাবি। কাজ শেষ হয়ে গেলে স্টুডিওতে গিয়ে বসি। তখন আর একলা লাগে না। মনে হয় তুমি ছড়িয়ে আছ সারা ঘরটাতে! হাত বাড়ালেই যেন তোমাকে পাব! কিন্তু আসলে আমি কি চাই জানো? আমি চাই তুমি খুব বড় শিল্পী হও। দেশ-বিদেশে তোমার নাম ছড়িয়ে পড়ুক। তোমার ছবি বেরুক। জীবনী ছাপানো হোক। তখন আমাকে যদি ছেড়েও যাও দুঃখ করব না।
কপালের ওপরে একগোছা চুল টেনে দিতে দিতে আমি বললাম, পাগলী এমন নাম আমি চাই না। আমি যদি শিল্পী হই তোমার মধ্যে দিয়েই হবো। অন্যভাবে নয়, আর পিরবোও না।
আগেই ভেবে রেখেছিল, হঠাৎ মনে পড়ার যেন ও বলল, আচ্ছা তুমি না বাইরে যেতে চেয়েছিলে? ঘুরে এসো না কয়দিন?
তুমি তো এক্ষুণি বললে, আমাকে এক মুহূর্ত না দেখে থাকতে পারো না?
বলেছি আর তা মিথ্যে নয়। ছবি বলল, কিন্তু তোমার জন্য আমি সব পারি! তুমি বিশ্বাস করো না?
গভীর আদরে মিশে যাওয়াই এ প্রশ্নের একমাত্র জবাব আমি তাই করলাম। বড় প্রেম শুধু স্বার্থপর নয় উদারও বটে।
হেমন্তের ছোঁয়া লাগছে আকাশের নীলে গাছপালায় দুর্বাঘাসে, হাওয়ায় হাওয়ায়। ঘরে ফসল উঠল! চড়ুইরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যায়, তাদের ঠোঁটে কিচির মিচির কলরব। ঘরে তখন নিবিড় আনন্দের অতল ধারা বাইরের আয়োজনে যোগ দিতে আর দেরি করব না। আর ঘর বাহির যে এক করতে চাই!
০৯. শারদীয় ছুটি শেষ
শারদীয় ছুটি শেষ হওয়ার পরে কিছুদিন কাজ করেছি- কাজেই সাতদিনের ছুটি চাইলে আপত্তি উঠল না। দু’তিনটি ছাত্র সঙ্গে আসতে চেয়েছিল তাদের আনিনি। দলের চেয়ে দলের সমস্যাটিই যদি হয়ে যায় বড় তাহলে যেজন্য বেরুচ্ছি সে উদ্দেশ্যটাই যাবে পণ্ড হয়ে এবং সে আমাদের কারুরই কাম্য নয়।
আমি আর মুজতবা যেদিন চাটগাঁ গিয়ে পৌঁছলাম সে ছিল শুক্রবার। সারারাত প্রায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো কাজেই একফোঁটা ঘুম হয়নি। এই শহরে বন্ধু-বান্ধব আছে, গিয়ে উঠলে অনাদর করবে না হয়তো; কিন্তু নষ্ট করার মতো সময় নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে একেবারে মাঠে গিয়ে নামাই আমাদের সংকল্প এবং কষ্টের জন্য তৈরি হয়েই এসেছি। লটবহর অতি সংক্ষিপ্ত । জানদুটো আর আঁকার সরঞ্জাম। এ দুয়ের মাঝখানে একটা বড় চৌকোণো ধরনের ক্যানভাসের ব্যাগ। এতে যাবতীয় খাদ্য সামগ্রী। তিনটে বিস্কুটের প্যাকেট, জেলি, মাখন এবং পাউরুটি। ব্রাশ টুথপেস্ট সাবান তেল আরও যা দরকার এর ভেতরে ছোটো একটা থলির মধ্যে আছে। ফ্লাস্কটা বাইরে আমার কাঁধে ঝুলানো।
মুজতবা আরো এসেছে দুবার। তাছাড়াও, বাইরে ও যে সত্যিই চৌকস করিৎকর্মা লোক তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এসব ব্যাপারে আমাকে ভাবতে হয়নি। জোগাড় যন্ত্র সমস্ত ওর। আমি যেন শুধু অনুগ্রহ করে এসেছি ওর সঙ্গে।
রেস্টুরেন্টে পেট পুরে পরোটা গোশত খেয়ে পথে বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম, মুজতবা বুঝতে পেয়ে আগেই বলে ফেলল, কিছু ভাবিসনে কেবল আমার সঙ্গে আয়!