ছবি অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, সত্যিই অদ্ভুত তো!
হা শোনো! নাড়টাড় কি আছে দাও তো। আর এক কাপ চা খাওয়াও। আমি একটু বৌদিদের ওখানে যাব।
আমার কথায় সহজ সুর থাকা সত্ত্বেও কেমন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় ছবি। বলল, ওখানে কেন?
নোটনকে নিয়ে আসি গে! একলা একলা আর কত ভালো লাগে।
ছবি যেন হঠাৎ জেগে উঠল! জিজ্ঞেস করল, সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
আমি উঠতে উঠতে বললাম, তুমি কেটলিটা চাপিয়ে দাও। আমি এক্ষুণি মুখ ধুয়ে আসছি!
আমি বাথরুমের দিকে পা বাড়ালে ছবি পথ রোধ করে বলল, শোনো!
আমি স্নিগ্ধস্বরে বলি, কি বল?
ছবি ঢোক গিলে বলল, এতকিছু যে বললাম তুমি কিছু মনে করনি? আমাকে খারাপ ভাবনি?
ও! পাগল! আমি হেসে উঠে বললাম, এতে মনে করার কি আছে! সাধারণ ব্যাপার! কতই ঘটে থাকে! তাছাড়া তোমার তো কোনো দোষ ছিল না! এজন্য তোমাকে খারাপ ভাবব?
আমার গা ছুঁয়ে বল, সত্যি বলছ তুমি? যদি সত্যি না হয় আমি মরে যাব। বলো বলো আমার গা ছুঁয়ে বলো!
আমি ওকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বললাম, সত্যি বলছি মনে করিনি। প্রথম ভেবেছিলাম বুঝি ভয়ঙ্কর কিছু, কিন্তু পরে বুঝলাম তোমার আমার ভালোবাসাই বড় সত্য!
কথাটা শেষ করার পর মুখের দিকে ঝুঁকে পড়তে ছবিও সাগ্রহে এগিলে এলো। কিছুক্ষণ পর মাথাটা আমার বুকে এলিয়ে আস্তে আস্তে বলল, সত্যি আমি ভাগ্যবতী।
দুইফোঁটা পানি বেরিয়ে এসে গালের উপর স্থির হয়ে ছিল, আমি মুছে দিলাম।
মেঘ যখন কেটে গেল আকাশে সূর্য, তারা, চাঁদ নীহারিকা দেখা দিতে দেরি হলো না। কঠিন আঘাতকে ভোলে মানুষ আর যা বিস্মৃতির যোগ্য তাকে আমি ভুলব না? ছবিও সংশয়মুক্ত। তাই কোমল পদ্মের মতো পরতে পরতে সে দল মেলেছে। ওর শরীরের বিন্দু বিন্দু অংশ মাতৃত্বের রসে গৌরবান্বিত হয়ে উঠছে ক্রমেই। চাহনি গভীর, হাসি আরো মধুর। সেবায় সুধা-স্পর্শ। নোটনকে এনেছিলাম ওকে নিয়ে থাকতে পারে বলে আমার কাজেরও সুযোগ হয়ে গেল।
প্রতিদিনই কিছু কাজ করি কিন্তু উপলব্ধি করি মনের মধ্যে পালাবদল হচ্ছে। এক ঋতু গিয়ে আসছে অন্য ঋতু। এতদিনকার ছবিতে রূপটাই ছিল প্রধান বাইরের চাক্ষুষ মূর্তি কিন্তু তাতে আর তৃপ্তি পাচ্ছি না। অন্যপথ দরকার, অন্যভঙ্গি। বস্তুর বাইরের রূপটাই তো চরম সত্য নয়? যদি তাই হয় তাহলে শুধুমাত্র একজনের চেহারা না একে চেহারায় তার আত্মাকে ফুটিয়ে তোলাই আসল কাজ। সমালোচনার বইয়ে পড়েছি বহু এবং সেই মতো চেষ্টাও করেছি কিছু কিছু, পান্নার ছেলে কোলে ছবিকে একদিন আঁকতে চেয়েছিলাম। আঁকতে চেয়েছি কিন্তু তখন উপলব্ধি বদলে ধারণাটাই ছিল জাগ্রত। ভালো আঁকা হতো বটে তবে ভালো ছবি হতো কিনা সন্দেহ।
এখন আশ্চর্য যা কিছু পরিকল্পনা জাগে মাথায় আত্মার সঙ্গে না মিলিয়ে তাঁকে দেখতেই পারি না।
এতে অবশ্য একটা বিপদ আছে। সে হলো অতিমাত্রায় অ্যাবৃট্রাকশনের প্রতি ঝোঁক, যার ফল মূল্যবোধের নেতি। আর শিল্পী যদি এমন হয় কামুর চরিত্রের মতো তার নির্বাসনে আর বেরুবার পথ নেই কারণ অতীত মোহ সব নিঃশেষ আর স্বপ্নের দেশ অলীক প্রমাণিত- জীবন আর ব্যক্তিত্বে করুণ বিচ্ছেদ, অভিনেতা আর মঞ্চে অসঙ্গতির পরাকাষ্ঠা। জীবনে এই হলো সামগ্রিক অর্থহীনতার অনুভূতি। তাহলে সেই শিল্পীর অস্তিত্বই সংকটাপন্ন। যে আত্মবিচ্ছেদের বন্ধুর যাত্রা তার অপমৃত্যু থেকে উত্তরণের পথ তাতে সফল হতে পারে আর কয়জন?
অথচ শিল্পীর জীবনে এমনি ধরনের আত্মিক সংকট অবশ্যম্ভাবী। কারণ সে আর দশ-পাঁচটা লোকের মতো নয়। বরং সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল। সেতারের সূক্ষ্ম তারগুলো বাজছে প্রতি নিয়তই এমন কি হাওয়ার ছোঁয়ায়ও সে স্থির থাকবে কি করে? ভাববেই, কাদবেই ভেঙে পড়বেই। আর একমুহূর্তে যে তাকে ভুলতে পারে স্নেহশীল পিতার মতো হাত ধরে সে হলো আস্থা। প্রতারণাকে বুঝেও বিশ্বাস। ঘৃণাকে নিয়েও প্রেম! মৃত্যুকে বুঝেও মানবতা অধ্যাত্মবাদী না হয়েও শিল্পী বলবে : হিরন্ময়েন পাত্রেণ সত্যসাপিহিতং সুখ। তৎ ত্বং পুষন্নপাকৃণু সত্য ধর্মীয় দৃষ্টায়ে। যৎ তে রূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি। যোহহসাবসৌ পুরুষঃ সোৎ সম্মি!
শিল্পীর কাছে সে সূর্য ছাড়া আর কি? সে যদি আমার কাছে তার আচ্ছাদন ক্ষণিকের জন্য সরিয়ে থাকে তাহলেই তো আমি ভাগ্যবান।
আসলে সংক্ষিপ্ত কোনো রাস্তাই নেই। মহৎ শিল্পী হতে গেলে সে সমস্তই মাড়িয়ে যেতে হবে। মাড়িয়ে যেতে হবে, হঠাৎ খাদে পড়ে গেলে নিমজ্জিত হলেও চলবে না। আগুনকে বুকে নিয়েই হতে হবে খাঁটি সোনা। মনকে বাঁচিয়ে রেখে নিজের মনের উর্ধে তাকে উঠতে হবে। কঠিন সাধনা।
এ বয়সে তা পুরাপুরি অর্জন করা অসম্ভব। কারণ এখন আবেগ অতিরিক্ত, বুদ্ধি মোহগ্রস্ত, প্রজ্ঞা অপূর্ণ এবং অভিজ্ঞতা সংকীর্ণ। তাই মাস্টারপিস নয় প্রস্তুতিই এখনকার কাজ।
কিছুদিন ধরে একটি ব্যাপার মন থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছি না-সে হলো নারী জীবনের সার্থকতা কোথায়? ছবির ব্যবহারটাই এ ভাবনার কেন্দ্র, সেজন্য ক্রমেই তা গভীরতা লাভ করেছে। নারীর জীবন কি প্রেম অথবা মাতৃত্ব? প্রেম ছাড়াও মাতৃত্ব সম্ভব; কিন্তু মনে হয় প্রেমের মধ্য দিয়ে যে মাতৃত্ব সেখানেই রয়েছে সত্য। কিন্তু পুষ্পের বোটায় পরিণত ফলের মতো প্রেমজ সন্তানেই নারী-পুরুষের সম্পর্কের সার্থকতা।