একদিন বিকেলে আসমানের দিকে চেয়ে আছি দেখি মেঘের ফাঁকে ফাঁকে একদল শিশু!
চোখ কচলিয়ে চাইতেই তারা যেন করতালি দিয়ে এক নিমেষে সব লুকিয়ে পড়ল।
ছবি একটু থেমে শেষবারের মতো বলল, অনেকদিন হয়ে গেল কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে ভুল করি আমি এবং যে কোনো শিশুর কান্না সইতে পারিনে। ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়।
কথা বলতে বলতে ওর গলা ভারি হয়ে এসেছিল, সে বালিশে মাথা এলিয়ে দিল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
মশারিটা খাঁটিয়ে দিয়ে আমি নামলাম। আচ্ছন্নের মতো ঘরময় পায়চারী করতে থাকি। এরপর দরোজা খুলে বারান্দায় গেলাম। সাদা মেঘগুলো দক্ষিণ থেকে মৃদুমন্দ গতিতে উত্তরে উড়ে যাচ্ছে, রাতের আকাশে পূর্ণচাঁদের মাতাল জোছনা। ছড়িয়ে পড়ছে। অফুরন্ত ধারায়। একি জোছনা অথবা ধারালো পরিহাস? মেথর পল্লী থেকে ঢিমিক ঢিমিক ঢোল-করতালের বাজনা ভেসে আসছিল, সাধারণের কি উল্লাস! ফুর্তি করছে সারাদিনের খাটুনির পর মদ আর তাড়ি টানছে দেদার, মেয়েমানুষের গলা জড়িয়ে মাতলামি করছে। হা এরাই সুখী! সত্যিকারের সুখী। কারণ এদের মনের বালাই নেই। বৌয়ের সঙ্গে এসেছে তার পূর্বস্বামীর ছেলে তাকে খাওয়াও মারধোর করো এর পর কাজে লাগাও। বাগ মানতে না চাইলে বিদায় দাও। আসলে বিয়েশাদি ব্যাপারটাকে একটা নেহায়েৎ দরকারি কাজ বলে ধরে নিতে পারলেই সকল সমস্যার সমাধান। মনের সূক্ষ্ম তন্ত্ৰীগুলোর সঙ্গে একে জড়িয়ে ফেলার মতো বোকামি আর কিছু নেই! তাতে মিছে জ্বালা মিছে যন্ত্রণা।
কিন্তু এও বোধ হয় ঠিক নয় কারণ যে কোনো চরমই অমঙ্গলকর। শুধু মাত্র হৃদয়াবেগ যেমন ঠুনকো তেমনি নির্জলা যান্ত্রিকতাও বিপজ্জনক এবং যেখানে আতিশয্যের আশঙ্কা আছে সেখানে স্থির মস্তিষ্কে অনুধাবনের ক্ষমতা অর্জন করতে পারলে খুব বড় ত্রুটিকেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
আর একথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, মানুষের পরিণতি নির্ভর মননের পরিপকৃতারই ওপর। মনন যেন আগুন এবং আবেগ আগুনের শিখা, যে কোনো একটা নিষ্প্রভ হয়ে গেলে শীতলতা অনিবার্য।
যদিও ভেতরে অনেক ক্ষোভ সঞ্চিত হয়েছে তবু অনেকক্ষণ একা একা বারান্দায় পায়চারী করতে করতে এটুকু বুঝলাম ছবির ঘটনাটাকে বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে বিচার না করলে আমি ভুল করতে পারি। আর সে ভুলের ফল হবে মারাত্মক। আমার অতিরিক্ত ভাবালুতার মানেই হবে ওর দুঃখ এবং দুঃখের ভার বেশি হলে একটা কিছু কাণ্ডও করে বসতে পারে।
এটাই সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমি সামান্য আঘাত করলেই এখন সে মুষড়ে পড়বে এবং তাতে আমার মনের ঝাল মিটবে কিন্তু ঐটুকুই আর কোনো লাভ নেই। অপর পক্ষে ইচ্ছে করলে আমি এখন ওকে মঞ্জরিত করে তুলতে পারি, করতে পারি আরো সার্থক ও সুন্দর। তার জন্য প্রয়োজন প্রেম এবং ক্ষমা।
‘যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি’ তারই পূজায় বলি হবার ইচ্ছেটা তো শুধু লাবণ্যের নয় বরং এটা আকাঙ্ক্ষিত জনের কাছে নরনারী মাত্রেরই দাবি।
এখন আমি ওকে ভালোবেসেছি কিনা এটাই প্রশ্ন। যদি বেসে থাকি তাহলে এতটুকু ক্ষমা করতে পারবো না? বিশেষত এ যখন একটা দুর্ঘটনা মাত্র, যার আবর্তে সে একান্ত অসহায় ছিল?
বিছানায় ফিরে এসে দেখি অকাতরে ঘুমাচ্ছে ছবি, এতদিনকার পুষে রাখা মেঘের ভারটুকু ঝরিয়ে যেন এখন সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত।
কিন্তু রাতের ঘুমে যা সম্ভব হয়েছে সকালের আলোতেও কি এ অক্ষুণ্ণ থাকবে? থাকতে পারে, তার একটা মাত্র উপায়। সে হলো আমার আনন্দ ও উচ্ছলতা। কাল সকালে আমি যদি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারি তখন ওর ওপরে তার যে আভা পড়বে তাতে ওর অন্তর বাহির একটি শিখায় দীপ্যমান হয়ে উঠবে। শাস্তির বদলে ক্ষমা, সঙ্কীর্ণতার বদলে মহত্ত্বের পরিচয় পেয়ে হবে আরো কৃতজ্ঞ।
সে কি আমি করতে পারি না? কতটুকু আত্মত্যাগের প্রয়োজন তার জন্য চেষ্টা করে দেখা যাক।
আঁকার একটা পিরিয়েড পুরো করবার জন্য বাইরে যাব ভাবছিলাম। মুজতবার সঙ্গে কথাও হয়েছে সপ্তাহখানেকের জন্য আমরা যাব চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায়। কিন্তু এখন যাওয়া ঠিক হবে না। এখন সামান্য পিছুটানও ওর মনে গভীর রেখাপাত করতে পারে।
মুজতবা হয়তো বিদ্রূপ করবে, বৌয়ের আঁচল বুঝি ছাড়াতে পারছিস না? ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ!
কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্যই এটুকু স্বীকার করে নিয়ে প্রোগ্রামের তারিখটা একটু পিছিয়ে দিতে হবেই।
আরো একটা জিনিস রয়েছে ভাববার মতো। ছবি অবচেতন মনের প্রবল আকুতিটার সমাপ্তি প্রয়োজন। কিন্তু তাকে স্থূলভঙ্গিতে দাবিয়ে দিলে হবে না। সেজন্য মনোবিকলনের আঁকাবাঁকা পথেই অগ্রসর হতে হবে। ডাক্তার নই, কিন্তু সাধারণ জ্ঞান। তো আছে? এইটুকু জানি কামনাকে পুর্তির মধ্য দিয়েই জয় করা সম্ভব। কোলের কাছে নতুন কান্না এলে হারিয়ে যাওয়া কান্নার রেশ আর কানে বাজবে না।
সকাল বেলায় আমার আনন্দিত কণ্ঠস্বর শুনে ছবি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মুখ ধোওয়ার আগে কাগজ দেখছিলাম। হঠাৎ ডেকে উঠলাম, ছবি! ছবি!
ও উঠে বিছানাপত্র গোছগাছ করছিল, অল্পক্ষণ এসে বিমর্ষ মুখে জিজ্ঞেস করল, কি!
আমি ওর হাত ধরে টানি। বললাম, দ্যাখ কি অদ্ভুত খবর। আঠারো বৎসরের তরুণীর ছিয়াত্তর বৎসরের বৃদ্ধকে বিবাহ! নারী রহস্যময়ী, তাতে আর সন্দেহ কী!