আসলে সমাজ ও সভ্যতা ছেঁড়াকোটের মতোই জরাজীর্ণ হয়ে গেছে, কাজেই এর মূল্যবোধের কোনো অর্থ নেই। শিল্পে ও জীবনাচরণে কিম্ভুতকিমাকার হওয়াটাই যুগের দাবি এবং এখানেই বিদ্রোহ। বিকৃতি ব্যাপক বলেই আকৃতির কোনো প্রয়োজন নেই। বিকৃতিকে অধিকতর বিকৃতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। যেমন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা, বিষের ওষুধ বিষ।
তাছাড়া, জীবনটা নাতিদীর্ঘ উত্তেজনা মাত্র, সেনসেসন। প্রতিমূহুর্তে সেই সেনসেসন লাভ করাই প্রধান কাজ। সে যে ভাবেই হোক। একজন মানবীর মাথার চুলে আদর করার চেয়ে কুকুরীর গাল চেটে যদি তা পাওয়া যায় তাহলে সেটাই কাম্য।
মুজিব রোমের একটি প্রাচীন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। যেখানে সে থাকত সেই বুড়ি বাড়িওয়ালির মধ্যবয়সী মেয়েকে সে ভালোবেসেছিল প্রায় রোমিওর মতো। ছুকরিদের সে পছন্দ করে না মোটেই, বলে মাকাল, বাইরে আকৃতি ও বর্ণ আছে বটে, কিন্তু কোনো স্বাদ নেই, গন্ধ নেই, গভীরতা নেই। ঐ মেয়েটিকে সে পাবে না জানত, তবুও ওর সবজি ব্যবসায়ী স্বামীর সঙ্গে যে খাতির হয়েছিল সেটাই পরম লাভ।
আমেদও প্রেমে ব্যর্থ হয়েই ধাক্কাটা সামলাবার জন্য জোগাড় যন্ত্র করে লন্ডন যায়। সেখানে ওর ভাই থাকতেন। কাজেই বিশেষ অসুবিধে হয়নি। বেশি বেশি টিপ দিয়ে সেও রেস্টুরেন্টের এক নাবালিকার সাথে ভাব জমিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন ওকে দিয়ে গোপনে একটা অস্বাভাবিক কাজের চেষ্টা করে। মলি ম্যানেজারের কাছে রিপোর্ট করে দিলে তাকে অনেক কড়াকথা শুনতে হয়েছিল।
এ বিষয়ে রায়হান সবচে দুঃসাহসী এবং উদার। নিজের নির্বাচিত মেয়েকে অন্য লোকের সাথে কেলিরতা অবস্থায় দেখতেই সে ভালোবাসে আর এভাবে সে যে উত্তেজনা লাভ করে তা অতুলনীয়, অকথ্য। কিন্তু এজন্য তিনটি মেয়ের সঙ্গেই হয়েছে ওর ছাড়াছাড়ি।
এরা আমার বন্ধু সেজন্য গৌরব বোধ না করে পারি না। ইউরোপে প্রত্যেকের একক প্রদর্শনী বহু সমঝদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, খবরের কাগজে সচিত্র সমালোচনার কাটিং দেখেছি। প্রথম পুরস্কার আমি না পেয়ে ওদের যে কেউ পেলে আরও খুশি হতাম। সেজন্য ভেতরে ভেতরে একটু লজ্জিত আছি। বন্দর রোডে পড়ে সোজা হাঁটতে শুরু করলে শুধোলাম, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?
তা জানার দরকার কি বাবা! পদাঙ্ক অনুসরণ করো চুপচাপ! এখানে তো আর বৌ নেই? হেঃ হেঃ হেঃ!
ফার্স্ট প্রাইজ পেলি, ফুর্তি লাগছে না? শয়তানের পাছ ধরে নরকে গেলেও এখন আনন্দিত হওয়া উচিত।
আরে ভালো কথা, কালকে কিছু ঢালিস্ তো? ছবি থেকে পাঁচশ’ টাকা পেলি, তিন বোতল খাঁটি মাল চাই, তার একরত্তিও কম নয়।
সাটেলি; সাটেলি! অদ্ভুত মুখ বানিয়ে রায়হান টেনে টেনে বলল, এবং সঙ্গে ঘিয়ে ভাজা পরটা আর মুরগির মাংস!
জিভটা বার করে এমনভাবে ঠোঁট চাটল, আমরা হেসে উঠলাম। আমি বললাম, টাকাটা আগে পেতে দাও। দ্রলোক কিনেছেন, করে নেন তার ঠিক কি।
যবেই নেন, নেবেন তো? ব্যস, সেদিন হবে। কিন্তু আসল কথা কি জানিস? টেনে ফেললে সবশেষ এখন তা ভাবতে যে পাচ্ছি, এটাই আসল! বলে রায়হান বাতাসে সশব্দে একটা চুমুক দিল।
ইয়েস! স্পিকিং জাস্ট লাইক অ্যান অ্যাংরি ইয়ংম্যান! আমেদ রায়হানকে বলল, কনুইটা বাড়িয়ে দে ওস্তাদ, চুমু খাই।
থামতে হলো। গম্ভীর ভঙ্গিতে ওদের কাণ্ডটা শেষ হবার পর আবার চলতে শুরু করি!
রাত সাড়ে এগারোটায় ছ’মাইল পথ হেঁটে গিয়ে দু’কাপ কফি চারজনে ভাগাভাগি করে খাওয়ার মধ্যে রোমাঞ্চ আছে বৈকি! সে রোমাঞ্চ আমিও পেলাম। তবে শরীরটা ঝিমিয়ে এলো, এই যা। রাত একটার সময় পা টেনে টেনে যখন হোটেলে এলাম, তখন মগজে কিছু অবশিষ্ট নেই। উদরে তো নয়ই। দারোয়ানের সঙ্গে ব্যবস্থা ছিল, ডাকতেই উঠে এলো। গেট পেরিয়ে কামরার তালা খুলে ভেতরে গেলাম। দেখি খাবার দিয়ে গেছে বয়। কি আর খাব। নানা রকম খাদ্যদ্রব্যে মনটা ঠাসা, আর এই তো যথেষ্ট। তবু পেটের জ্বালায় খানিকক্ষণ বসে দু’টো রুটি চিবোই।
পীড়াপীড়ি করতে থাকায় আমাকে গালাগালসহ গেটের কাছে পৌঁছে দিয়ে ওরা আবার বেরিয়ে পড়েছিল। রাত তিনটে না বাজলে নেশা জমে না।
পরদিন ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। করাচীর কর্মব্যস্ত উজ্জ্বল সকাল। গোসল করে নাস্তা খাওয়ার পর আস্তে ধীরে বেরুলাম। দিয়ে দেখি একজিবিশন হলের দরোজা খোলা হয়েছে যথারীতি। এ বেলায় লোকের ভিড় নেই, তাছাড়া শিল্পীদের উপস্থিত থাকারও কোনো কথা ছিল না। নেহাৎ ভাড়া দিয়ে এনেছে এবং প্রথম দিন বলে গতকাল উপস্থিত ছিলাম। আজকে আসার প্রধান কারণ, ছবির টাকাটা পাওয়া যায় কি না।
ভাগ্যি ভালো পেয়েও গেলাম বারোটার সময়। আরও ছবি বিক্রি হয় তো হবে, নয় এই যথেষ্ট। কেনাকাটার যে ফিরিস্তি এনেছিলাম তার জন্য চারশ’ টাকার প্রয়োজন ছিল। এখন হাতে আছে পাঁচশ’ মন্দ কি?
মায়ের দুর সম্পর্কের বোন জোবেদা খালা এই শহরেই বাস করেন। নামকরা একজন মাদ্রাজি ব্যবসায়ী তার স্বামী। আমি আসছি চিঠিতে জানিয়েছিলাম। প্রথম দিনই বিমানবন্দরে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। গাড়িতে এলাম বটে কিন্তু তাঁর বাড়িতে উঠি নি। কারণ থাকবার ব্যবস্থা আগেই করা হয়েছিল। এসেছি দেখবার জন্য, বন্ধু-বান্ধবদের। সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শটাও লোভনীয়।