সুরেশ্বর তার যৌবনে দিবাকরের দলে ছিল না, কিন্তু সে দিবাকরের মতনই সরল, জীবন্ত ছিল, শিষ্ট ও নম্র ছিল। দিবাকর তাকে ভালবাসত, বলত: তুই বড় সাবধানী, ইউ আর এ ক্যাট…তোর শালা কখনও কিছু হবে না। ওরে সাবধানী পথিকবারেক পথ ভোলো5; পোয়েট বলেছে পথ ভুলতে, তুই শালা একেবারে সিধে সড়কে চলেছিস।
হয়তো দিবাকর ঠিকই বলেছিল, সুরেশ্বর সাবধানী ছিল। সাবধানী মানে এই নয় যে, সে জীবনের বাইরে বাইরে ছিল। তার কখনও মনে হয়নি, জীবন নিয়ে খেলা করে কিছু পাওয়া যেতে পারে। সে মধুর, সন্তুষ্ট, শিষ্ট থাকতে চেয়েছিল, এবং জীবনের প্রতি তার আবেগ ছিল সাধারণ মানুষের মতন। তার বন্ধুরা তাকে বরাবর ভালবাসত, মাস্টারমশাইরা স্নেহ করত, হেমদের বাড়িতে সকলেই তাকে পছন্দ করত।
এইভাবে যৌবনের প্রথমটা কাটল, তারপর আবার দেশবাড়িতে গিয়ে থাকতে হল, বাবা মারা গেল, সংসারে একেবারে একা, জমিজায়গা সম্পত্তি, কলকাতা থেকে বাবার উপপত্নীর সেই সম্পত্তি দাবি করে চিঠি, মামলা করার শাসানি। সুরেশ্বর কলকাতায় চলে এল আবার।
জীবনের এই পর্বটাও সুখে দুঃখে, কখনও ক্ষোভে, কখনও রোমাঞ্চে ভরা। সম্পত্তির সমস্যাটা মিটোতে হল বলে সুরেশ্বরের কখনও ক্ষোভ হয়নি, সে স্বেচ্ছায় যা দেবার দিয়েছিল। তারপর হেম…হেমের অসুখ…
সুরেশ্বর এখানে আবার যেন বাধা পেল এবং চিন্তাটা কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল। হেমের অসুখ, জীবন-মৃত্যুর সেই দ্বন্দ্ব, হেমের সেই অসহায়তা, তাদের সংসারের মাথার ওপর আকস্মিক সেই বজ্রপাত–এসব এখন অতি দুরের অস্পষ্ট ছবির মতন হয়ে গেছে। অস্বীকার করে লাভ নেই, তখন সেই বয়সে এবং অবস্থায় সুরেশ্বর হেমের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। যৌবনের সেই প্রেম তাকে উদ্বেল করেছিল, হেমের জন্যে তার দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না। হেমের সাহচর্য, সঙ্গ, হেমের সুস্থতা তার একমাত্র কাম্য বিষয় ছিল। হেম যখন সুস্থ হয়ে উঠল তখন সুরেশ্বরের জীবনে এমন একটা স্বাদ এসেছিল যা আগে আর কখনও সে অনুভব করেনি। হেমের দেহমন যেন তার, হেমের নিশ্বাস যেন তার শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে মিশ্রিত, হেমের হৃদয় যেন তার হৃদয়ের অন্তর্ভুক্ত।
এই সুখ, এই স্বাদ, এই আনন্দ মনে হয়নি কোনওদিন নৈরাশ্য আনবে। অথচ কী যেন হল, হেম আর তার আনন্দের কারণ হয়ে থাকল না। কী যেন নেই, কী যেন হারিয়ে গেছে, কোথায় যেন কিছু শূন্যতা থেকে যাচ্ছে–এরকম একটা ভাব ছিল মনে। অবসাদ লাগত। মনে হত, এই প্রেম কি আমায় সব দিতে পারে? কেন এরকম হতে শুরু হয়েছিল সুরেশ্বর জানে না। তার শুধু মনে হত কোথাও যেন একটা মিথ্যা আছে। হয় তার মনে, না হয় এই প্রেমে।
এমন সময় নির্মলার সঙ্গে তার পরিচয়। নির্মলা তার পরিণত যুবক বয়সের মনটিকে যেন কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। বিশ্বসংসারে এত দুঃখ, বেদনা, বঞ্চনা, অসুস্থতা, ব্যর্থতা আছে যার বুঝি পরিসীমা নেই; তবু মানুষ কী আশ্বাসে বাঁচবে? কেন বাঁচবে? নিরর্থক জীবনধারণে কোনও সান্ত্বনা আছে? নির্মলা বলত: আছে কিছু আছে; খুঁজে দেখো না কী পাও!
নির্মলার সংস্পর্শে এসে সুরেশ্বর তার চরিত্রের নকল সাজসজ্জাকে চিনতে পেরেছিল, অনুভব করতে পেরেছিল সে কত অকর্মণ্য, কোথায় তার স্বার্থ, কী ভীষণ তার অহঙ্কার, ভীরুতা, কত অবজ্ঞেয়, তার উদারতা। জীবনের সঙ্গে তার নিষ্ক্রিয় সম্পর্ককে আবিষ্কার করতে পেরে সুরেশ্বর তখন বেদনার্ত হয়েছিল।
অন্ধকারে কে যেন সহসা বলল, নির্মলা তোমায় কী দিয়েছিল?
সুরেশ্বর অন্ধকারের মধ্যে প্রায় নিশ্বাসের মতন সুরে এই প্রশ্নটি তার কানের কাছে শুনতে পেল। শুনে বিস্মিত হল না, বিভ্রান্ত হল না। নির্মলা তাকে কী দিয়েছিল এ কথা কি বলা যায়!
নির্মলা তোমায় সংসার থেকে, জীবন থেকে, ভালবাসা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়নি?
সুরেশ্বরের এবার যেন হাসি পেল। নির্মলাই শেষ পর্যন্ত জীবনে যতটুকু দেবার সুরেশ্বরকে দিয়েছে।
সে আমায় এই বৃহৎ সংসারে অকস্মাৎ যেন ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল। আমি একা, আমি নিরাশ্রয়, আমার কোনও সান্ত্বনা নেই, সাহস নেই, বিশ্বাস নেই, উদ্দেশ্য নেই। কী মূল্য তবে এই জীবনের? কেন আমি বাঁচব? কী আমি পেতে পারি?
এই শূন্যতা এবং অবিশ্বাসের মধ্যে আমি আমার জীবনের অর্থ অন্বেষণ করতে চাইছিলাম। কলকাতা ছেড়ে আমি চলে গেলাম। সেই যে–ক্ষ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশ-পাথর–সেই রকম। আমি সাধু সন্ন্যাসী, ফকির, বিদ্বান, বুদ্ধিমান, ধর্ম-প্রতিষ্ঠান নানা জায়গায় ঘুরেছি। আমার কোনও সান্ত্বনা জোটেনি। এমন কিছু পাইনি যাতে মনে হয় আমার হৃদয় জুড়োল। অথচ আমি অনুভব করতাম, নির্মলার দেওয়া সেই শেষ আবিরটুকু আমার কপালে দিব্য চুম্বনের মতন আঁকা আছে। কিছু আমায় পেতেই হবে।
অবশেষে একদিন আমার কাছে আমার জীবনের অর্থ ধরা দিল।
সেটা কী?
সুরেশ্বর এবার হাসল যেন, বলল: আজ আমায় ঘুমোতে দাও।
সুরেশ্বরের চোখের পাতা বুজে এসেছিল।
.
৩২.
সকালের বাসেই হৈমন্তী চলে এসেছিল। আসার সময় গুরুডিয়া থেকে লাইটার মোড় পর্যন্ত হেঁটে এসে বাস ধরেছে। পথটুকু এবং সকালটি এত মনোরম ও স্নিগ্ধ লেগেছিল যে হাঁটার ক্লান্তি সে অনুভব করেনি, বরং আসার সময় চোখ চেয়ে চেয়ে দেখেছে এবং অনুভব করেছে শীত যেন পিছু ফিরে তাকাতে তাকাতে অনেকটা দূরে চলে গেছে, আর তাকে দেখা যাচ্ছে না; তার বদলে বসন্ত এসে গেছে। অস্পষ্ট একটি গুঞ্জন যেন অনুভব করা যাচ্ছিল বসন্তের।