চিন্তাটা সুরেশ্বরের যেন তেমন মনঃপূত হল না। সে অন্য কিছু ভাবতে গেল, ভাবতে গিয়ে দেখল, এই স্বপ্নের মধ্যে বাবা একটি পৃথক অংশ এবং মা, নির্মলা, বিনুমাসি অন্য অংশ; বাবা জীবনের সেই অংশ–যেখানে জীবনের অর্থ: ভোগ, ফুর্তি, সুখ, অপচয়, অসংযম, স্বার্থপরতা, নীচতা–এমনকী নিষ্ঠুরতা। মা, নির্মলা, বিনুমাসি–জীবনের অন্য অংশ; যেখানে মূর্খতা, অভিমান, অহঙ্কার, নৈরাশ্য, বেদনা, সহিষ্ণুতা, স্নেহ, প্রেম–এমন কী আত্মনিগ্রহ।
সুরেশ্বর এবার যেন অনেকটা সন্তুষ্ট হল। বাবা যে জীবনকে ভোগ্ন করেছিল, এবং ভোগ করতে বসে বিবেকে কোথাও বাধা পায়নি তাতে সন্দেহ নেই। দীর্ঘকাল বাবা বাঁচেনি; যতদিন বেঁচে ছিল নিজেকে রংমশালের মতন পুড়িয়ে ফেলেছে। তার জন্যে বাবার না অনুশোচনা, না দুঃখ। এমনকী বাবা তার উপপত্নীর এবং সেই সন্তানের জন্যেও কোনও মায়া-মমতা অনুভব করেনি, তাদের জন্যে কিছু রেখে যায়নি; ভোগের বিষয়, বস্তু ও তার পরিণতির মতন ওদের দেখেছে। …বাবার চরিত্রে নীচতা এবং নিষ্ঠুরতারও সীমা নেই।
মার মৃতদেহের পাশে নির্মলা এবং বিনুমাসি যে কেন বসে ছিল–এবার সুরেশ্বর বুঝতে পেরে আর অবাক হচ্ছিল না। মার পাশে ওদের মানায়, যদিও ওরা এক নয়। স্বতন্ত্র এবং পৃথক হলেও এই অংশে জীবনের বিষাদ এবং ব্যর্থতা, শোক ও ক্রন্দন রয়েছে। মার আত্মহত্যা, নির্মলার মৃত্যু–এরা একরকম নয়; মার ভাগ্য বিড়ম্বনা বা নির্মলার ভাগ্য এক নয়; মার মধ্যে নির্মলার সেই অদ্ভুত উদাসীনতা, নির্লিপ্ত সহিষ্ণুতা, ঈশ্বর-বিশ্বাস ছিল না। বিনুমাসি বেচারি একেবারে সাদামাটা, স্নেহ মমতা ছাড়া তার রূপ নেই চরিত্র নেই, সন্তানের মতন লালন-পালন করেছে সুরেশ্বেরকে; তবু বিনুমাসি দুঃখী; দুঃখী, কারণ বিনুমাসি সারা জীবনেও নিজের জন্যে কিছু পায়নি।
সহসা স্বপ্ন-বিষয়ক চিন্তাগুলি এলোমেলো হয়ে মন থেকে সরে গেল, গিয়ে অবনীর কথা মনে পড়ল সুরেশ্বরের। এবং কেমন যেন অজ্ঞাতসারেই সে অবনীকে স্বপ্নের ছবির মধ্যে দাঁড় করাতে গিয়ে দেখল অবনীর কোথাও স্থান হচ্ছে না। বাবার পাশে অবনীকে দাঁড় করানো যায় না–যদিও বাবার চরিত্রের একটা জিনিস অবনীর মধ্যে আছে: অপচয়–জীবনকে অপচয় করার কামনা। নির্মলা, মা এবং বিনুমাসির দিকেও অবনীকে রাখা যায় না, যদিও অবনীর কোথাও গভীর কোনও বেদনা ও নৈরাশ্য রয়েছে। অবনী ওদের মতন নয়, কোথাও যেন আলাদা।
সুরেশ্বরের হঠাৎ মনে হল, অবনী তার পিতার উপপত্নীর পুত্র হতে পারত, হলে অবাক হবার মতন কিছু ছিল নাঃ যদিও অবনী তা নয়, তার বাবার উপপত্নী থিয়েটারের অভিনেত্রী ছিল না। ভাগ্যের দিক থেকে উভয়ক্ষেত্রে একটা সাদৃশ্য রয়েছে এই মাত্র।
অবনী তাকে সংসার এবং জীবন চেনাতে এসেছিল। সুরেশ্বর যেন সামান্য বিহ্বল বোধ করল। কাতর হল। আমি জীবনের কিছু দেখিনি? বাল্যকাল থেকে যাদের দেখেছি তারা তো আমার জীবনের বাইরে ছিল না, তারা কেউই এই সংসারের বাইরেও নয়। আমার জন্যে কোনও আলাদা ব্যবস্থা হয়নি সংসারের, আমি ভাগ্যবন্ত ছিলুম না, সংসারের অনেক নোংরামি, কদর্যতা, হৃদয়হীনতার সঙ্গে আমার আজন্ম পরিচয়।
বালক বয়স থেকে আমি একা, আমার কোনও সঙ্গী ছিল না, আমি মার নজরে নজরে শিশুর মতন বেড়ে উঠেছিলাম। মার সব সময় ভয় ছিল আমি অপঘাতে মরব। জানি না কেন, মার মনে এই ধারণা জন্মেছিল। বাবাও আমার শত্রুতা করতে পারে-মা এরকমও ভাবত। ফলে বাবার সঙ্গে আমার পিতা-পুত্রের সম্পর্কটা কোনও কালেই আন্তরিক হয়নি। সেদিক থেকে আমাকে পিতৃহীন বা পিতার পালিত-পুত্রও বলা যায়। মাও আমার সঙ্গী ছিল না। আমার ওপর মার দৃষ্টি ছিল মাত্র, অন্তর ছিল না। একদিন মা শীতের দুপুরে রোদে চুল এলিয়ে বসে পানের বাটা পাশে রেখে বিন্তি খেলছিল, আমি কাছাকাছি জায়গায় খরগোসের খাঁচা নিয়ে বসে খেলছিলাম, খাঁচার মধ্যে থেকে খরগোসটা কী করে যেন বেরিয়ে এসে দালান বয়ে তরতর করে পালাল; আমি ছুটে তাকে ধরতে যাচ্ছিলাম; মা বলল, কোথায় যাচ্ছিস? বললাম, আমার খরগোসটা পালিয়েছে। মা বলল, থাক, পালাকগে যাক, তুই যাবি না। অন্য খরগোস আনিয়ে দেব। ..মা যতদিন বেঁচে ছিল কোনও দিনই আমার নিজের জিনিস নিজেকে ধরে রাখতে, বেছে নিতে দেয়নি। মার আঁচলের তলায় তলায় বেড়ে ওঠা ছাড়া আমার কোনও স্বাধীনতা ছিল না, মুক্তি ছিল না। আমি যে ছেলেবেলায় কিছুটা নির্জীব, সঙ্গীহীন, ভীতু ছিলাম তা মার জন্যে। মা মারা যাবার পর আমার আশেপাশে আর দেওয়াল থাকল না, বাবা আমায় অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিল, কারণ আমাদের মধ্যে কোনও গভীর ও আন্তরিক সম্পর্ক না থাকায় বাবার পক্ষে তখন আমায় স্বাধীনতা না দিয়ে উপায় ছিল না। আমি জীবনের সেদিকে যেতে পারলাম না–যেখানে অগণিত মানুষ স্নান্যাত্রায় চলেছে, যেখানের জল গন্ধক কূপের মতন টগবগ করে ফুটছে। সুযোগ এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমি উল্লাসের দিক থেকে সরে থেকেছি।
ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে গেল, সুরেশ্বর যেন হঠাৎ কেমন একটা ব্যবধানে সরে এল। কিছুক্ষণ আর তার উৎসাহ থাকল না, অনেকটা দূরে বসে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকার মতন সে অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকল, বিশেষভাবে সে কিছু দেখল না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে খাপছাড়া ভাবে সে এটা-সেটা মনে করতে এবং দু-চারজনকে যেন দেখতে পেল। কোথাও তার মন বসল না, শুধু পুরনো এক বন্ধু দিবাকরকে মনে পড়ল; মনে পড়ল দিবাকর বলত: আমি রোজ রাত্রে একবার করে লাইফের ব্যাটারিটা চার্জ করিয়ে নি,বুঝলি; সকালে একেবারে নিউ ব্যাটারি; শালাকম ছুটতে হবে…। সুরেশ্বর মনে করতে পারল, কলকাতায় হোস্টেলে থেকে বি-এ পড়ার সময় দিবাকর একদিন কোথায় পালিয়ে গেল, মাসখানেক পরে জানা গেল সে ভদ্রেশ্বরের দিকে রেলে কাটা পড়েছে। কী করে, কী কারণে এসব ঘটেছিল কেউ জানল না। কিন্তু দিবাকরের জীবনে দৌড়টা বেশিদিন টিকল না।