স্বপ্নটা বিচিত্র। মার মৃত্যুর সময় বিনুমাসি বা নির্মলার থাকার কথা নয়। বিনুমাসি তখন তাদের কাছে ছিল না, মা তাকে অনেক আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছিল সংসার থেকে, তীর্থে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এমনকী মার মৃত্যুর খবরও বিনুমাসি দেরিতে পাওয়ায় শ্রাদ্ধের সময় আসতে পারেনি। তবু স্বপ্নে মার মৃতদেহের সামনে বিনুমাসিকে কেমন যেন মানিয়ে গেল।
নির্মলার সঙ্গে মার কোনও রকম যোগাযোগ ঘটার কথাই ওঠে না। র কথা নির্মলা কিছু কিছু শুনেছিল মাত্র, সুরেশ্বরই বলেছিল। সেই নির্মলা যে কী করে মার মাথার সামনে এসে বসল, কে জানে? স্বপ্নে সবই সম্ভব। তবু নির্মলাকেও খুব বেমানান দেখাচ্ছিল না। সবচেয়ে যা অদ্ভুত এবং বেমানান তা হল বাবা। বাবা যে কী করে ছড়ির মতন লম্বা একটা রংমশাল জ্বালিয়ে মার পালঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল, কে জানে। বাবা কী দেখাতে চাইছিল?
সুরেশ্বর যেন ভাববার চেষ্টা করল, বাবা কী বেশে দাঁড়িয়েছিল। মনে করতে পারল না। কলকাতার কাজ সেরে যখন বাবা বাড়ি ফিরত বাবার পোশাকের কিছু অদলবদল ঘটত। দামি সিল্কের পাঞ্জাবি, ফরাসডাঙ্গার ধুতি, হাতে ছড়ি, পায়ে চকচকে পাম্পশু। একবার বাবা যখন কলকাতায় গিয়ে মাস খানেক পরে ফিরল, যেদিন ফিরল, পরের দিনই সকালে মাকে মার শোবার ঘর থেকে ফাঁস-খাওয়া অবস্থায় বের করে আনতে হয়েছিল। বাবা তখনও নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে, আকাশটা সেদিন মেঘে মেঘে কালো হয়ে ছিল সকাল থেকেই, বৃষ্টি পড়ছিল, থামছিল, পড়ছিল। ঝাঁপটা দিচ্ছিল। মেঘ ডাকছিল।
সুরেশ্বর মার মৃত্যু এবং আনুষঙ্গিক ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে মনে করছিল এবং ভাবছিল। দেশের বাড়িতে মার নিজের ঘরটি ছিল পুব মুখো, জানলা খুললে নদীর একটা দিক দেখা যেত, আর দেখা যেত আদিগন্ত ফসলের মাঠ-নদীর ওপারে। মার ঘরে ভারী ভারী সেকালের প্রচুর আসবাবপত্র ছিল। যখন মার মাথার গোলমাল শুরু হয়ে গেল তখন একে একে এবং নিজের খেয়ালে মা সব ঘর থেকে বের করে দিতে লাগল; বিলিতি একটা কাচের মস্ত আয়না, শোবার পালঙ্ক আর গহনার সিন্দুক ছাড়া মার ঘরে আর কিছু ছিল না শেষ পর্যন্ত। পানের বাটা আর সোনার দাঁতকাঠিও থাকত। মার রূপের অহঙ্কার ছিল না, তবু যখন খুব অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ত তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সেই অসামান্য রূপ নিজেই দেখত, কোনও কোনও সময় কোনও লজ্জাও রাখত না। বাবাকে এ সময় ধারেকাছে কোথাও দেখা যেত না। অবশ্য বাবা দাম্পত্য সম্পর্ক মার সঙ্গে রাখেনি; সাংসারিক সম্পর্ক রেখেছিল। দিনের বেলায় বাবার খাবার সময় দিনান্তের মধ্যে একবার মাত্র মা বাবার সামনে এসে বসত এবং তখনই যা দেখা-শোনা কথাবার্তা হত স্বামী-স্ত্রীতে।
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, মা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু সুরেশ্বরের পরে সন্দেহ হয়েছিল, মা যেদিন আত্মহত্যা করে সেদিন বাবা কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর রাত্রে মার ঘরে গিয়েছিল এবং মা ও বাবার মধ্যে কোনও রকম কলহ হয়েছিল। খুব সম্ভব মা সেদিন জানতে পেরেছিল কলকাতায় বাবার উপপত্নীর গর্ভজাত আর-একটি সন্তান আছে। মার অহঙ্কারে এবং সম্মানে, হয়তো আভিজাত্যে এটা লেগেছিল। যদিও বাবার ভোগসুখের বিষয়ে মা অবহেলা দেখিয়েছে, অন্য রমণীর সঙ্গে বাবাকে বসবাস করতে দিয়েছে, তবু মা বাবার এই দ্বিতীয় সন্তানকে সহ্য করতে পারেনি। বাবা মাকে কী বলেছিল, কী কলহ হয়েছিল তা সুরেশ্বর জানে না। এ সবই তার অনুমান। আত্মহত্যার পর মার ঘরের দরজা ভেতর থেকে খোলা ছিল, এবং বাবা যে মার ঘরে গিয়েছিল তার প্রমাণ হিসেবে বাবার সিগারেট-কেস মার ঘরে পড়ে ছিল। পরে শ্রাদ্ধান্তে বাবা যেদিন মার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন করেছিল–সেদিন বাবা নিজের অজ্ঞাতসারে যেন কলহের বিষয় কিছু বলে ফেলেছিল। সুরেশ্বর ছাড়া অন্য কারও তা জানার কথা নয়। সুরেশ্বরও তখন ভাল বোঝেনি।
বাবা যে কেন এরকম একটা অবস্থায় রংমশাল জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকল–সুরেশ্বর বুঝতে পারছিল না। মার মৃত্যু কি বাবার কাছে উৎসবের বিষয় হয়েছিল? ছেলেমানুষের মতন আহ্লাদ দেখিয়ে বাবা রংমশাল জ্বালাবে? বস্তুত মার মৃত্যুতে বাবার লাভ বা লোকসান কিছুই হয়নি। বেঁচে থেকেও মা বাবার বাধা ছিল না, মরে গিয়েও বাবার কোনও বাধা দূর করেনি। মার অবর্তমানে বাবা যে আর-একবার বিবাহ করেছে, বা কলকাতায় রাখা উপপত্নীকে পত্নীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে এনেছে, তাও নয়। তা হলে এমন কী আনন্দের কারণ ঘটল যাতে বাবা রংমশাল জ্বালিয়ে মার মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে!
স্বপ্নের অর্থ আবিষ্কারের জন্যে সুরেশ্বরের অস্থির বা ব্যাকুল হবার কোনও কারণ ছিল না। সে ব্যাকুল হচ্ছিল না। তবু এই অদ্ভুত বিসদৃশ ছবিটি তাকে খানিকটা অস্বস্তি দিচ্ছিল। আরও কিছুটা এলোমেলো ভাবনার পর তার মনে হল, বাবা যেন মার তরফের ছবিটা দেখাবার জন্যে রংমশাল হাতে দাঁড়িয়ে ছিল, হুস হুস করে রুপোলি ফুলকি ছড়িয়ে যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল বাবা সেই আলো দিয়ে মাকে চেনাচ্ছিল: ওই তোমার মা, মূর্খ, অহঙ্কারী, পাগল; মরতে জানে, বাঁচতে জানে না। ওর সমস্ত জীবন ওইভাবে কেটেছে–পালঙ্কের ওপর চুল ছড়িয়ে শুয়ে, দাসীর হাতে আলতা পরে। তুমি ভেবো না বিনু কাঁদছে, বিনু তোমার মার পায়ে আলতা পরিয়ে দিচ্ছে।