খেতে বসে সুরেশ্বর আবার অবনীর কথা ভাবল। অবনীর সঙ্গে যেন আরও অনেক কথা হতে পারত, হয়নি। অল্প দু-চারটে কথা অবশ্য অবনী বলেছিল পরে। সেগুলো তেমন কিছু নয়, তাতে তাপ ছিল না, ব্যাকুলতা ছিল না। বোধহয় একেবারে অকল্পনীয় অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বিহ্বল ও বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল; কী বলবে না বলবে, কী বা ভাববে ঠিক করতে পারছিল না; মানুষের বদ্ধমূল ধারণা অপ্রত্যাশিতভাবে নাড়া খেলে যা হয়। অবনী যেন সহজে আর-কিছু ভেবে নিতে পারছিল না। একবার এমনও মনে হল, সে এসব বিশ্বাস করতে পারছে না, ভাবছে তাকে জব্দ করার জন্যে সুরেশ্বর মিথ্যে কথা বলেছে। অবিশ্বাস এবং ক্রোধ তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছিল, কিন্তু তা সাময়িক। বিশ্বাস না করে তার উপায় ছিল না। অত্যন্ত নিরাশ হয়ে পড়ার মতন তখন অক্ষম হয়ে নিজের ওপরেই বিরক্ত হচ্ছিল। অবনীর আচরণকে আস্ফালন বলা যায় না, সুরেশ্বরের কাছে সে আস্ফালন দেখাচ্ছিল না–তবু, জীবন সম্পর্কে, জীবনের দুঃখ ও তিক্ততা সম্পর্কে অবনীর যেন কেমন একটা অহঙ্কারের ভাব ছিল, অবনী সেই অহঙ্কার নিয়ে বুঝি লড়তে এসেছিল, এসে দেখল তার অহঙ্কার অর্থহীন। নিজের ব্যর্থতার জন্যে সে বিব্রত, লজ্জিত ও আড়ষ্ট হয়ে গেল।
সুরেশ্বরের মনে হয়েছিল, যদি অবনী তখন অতটা বিমূঢ় ও বিক্ষুব্ধ না হত তা হলে হয়তো আরও কিছু বলত। বলার আবেগ তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছিল, সে উত্তেজিত হয়েছিল। কিন্তু আঘাত এবং নৈরাশ্য অবনীকে বিপর্যস্ত ও নির্বাক করে ফেলল।
অবনীর চরিত্রে, সুরেশ্বর যতটা তাকে চিনেছে, এক ধরনের ক্রোধ ও বিরক্তি আছে যা অনেকটা আত্মগ্লানির মতন। এই আত্মগ্লানি তাকে মাঝে মাঝে নির্দয় করে, উত্তেজিত ও অসংযত করে। সুরেশ্বর বুঝতে পারল না, নিজের সম্পর্কে গোপনে অবনীর যে হীনমন্যতাবোধ তা থেকে এই মানসিক তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে কে না। হতে পারে এটা অন্যতম কারণ।
খাওয়া শেষ হয়েছিল সুরেশ্বরের; উঠে পড়ল। পাত্রগুলো এক পাশে সরিয়ে রাখল। রাখার সময় চোখে পড়ল, মালিনী কয়েক চামচ চিনিও রেখে দিয়েছিল, দুধের বাটির পাশে কাচের ছোট্ট পাত্রে চিনিটুকু পড়েই থাকল।
বাইরে গিয়েছিল, হাত-মুখ ধুয়ে ফিরল সুরেশ্বর; বসার ঘরের দরজা বন্ধ করেছিল আগেই ও-ঘরের চটের সিলিংয়ের ফাঁক-ফোকরে কটা চড়ুই বাসা বেঁধেছে, রাত্রে মাঝে মাঝে ফরফর করে ওঠে। সেই রকম একটা শব্দ হল। শোবার ঘরে একটি জানলা খোলা, বাতাস আসছিল। সুরেশ্বর মুখে দুটি লবঙ্গের দানা ফেলে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। মাঠে নরম জ্যোৎস্না ছড়ানো, অল্প অল্প হিম ঝরেছে রাত্রে, চারপাশ অসাড়, নিস্তব্ধ। দুরের দিকে তাকালে হিম-জ্যোৎস্না মাখানো মাঠটা জলাশয়ের মতন দেখাচ্ছিল। কাছাকাছি এবং তফাতের ফুল-পাতার ঝোপ, গাছগাছালি যেন নিদ্রিত।
দূরে মাঠের দিকে তাকিয়ে সুরেশ্বরের হঠাৎ মনে হল, যাবার সময় অবনী তেমন হুঁশের মধ্যে ছিল না, বোধহয় হেমের সঙ্গে দেখা করেও যায়নি। অস্থিরচিত্ত, বিমর্ষ, অন্যমনস্ক অবস্থায় অবনী যদি সোজা গাড়িতে গিয়ে বসে থাকে, তবে ওই অবস্থাতেই সে চলে গেছে। এত অস্থির মন নিয়ে ওই ফাঁকা দিয়ে মাঠঘাট পেরিয়ে অবনী চলে গেল ভেবে সুরেশ্বরের সামান্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।
জানলা থেকে সরে এল সুরেশ্বর। ঘরের মধ্যে কয়েক পা হাঁটল। ঘড়ি না দেখেও বোঝা যায় রাত হয়েছে। মালিনী মশারি টাঙিয়ে পাশগুলো চালের ওপর তুলে রেখে গেছে। সুরেশ্বর মশারির কোণগুলো আরও একটু টেনে নিল, নিয়ে মশারি ফেলে বিছানার পাশে পাশে গুঁজে নিল। বাতি নিবিয়ে এসে শুয়ে পড়ল।
রাত্রে এখনও শীত আছে, র্যাগ গায়ে টেনে নিতে নিতে সামান্য যেন শীতধরার মতন লাগল, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। শুয়ে শুয়ে এই শিহরনটুকু দমন করে নিল। খুব সম্ভব সর্দিজ্বরের পর তার শরীরের দুর্বলতাটুকু এখনও পুরোপুরি কাটেনি, সামান্যতেই শীত গায়ে লাগছে।
অন্ধকারে চোখের পাতা বন্ধ করে শুয়ে থাকতে থাকতে সর্বাঙ্গ কেমন অবশ হয়ে এল, স্নায়ুগুলিতে যেন সাড় থাকল না, বিছানার স্পর্শও গায়ে লাগছিল না, মনে হল তার চেতনা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। হঠাৎ, এই রকম মুহূর্তে, তন্দ্রার মধ্যে চকিতে সুরেশ্বর স্বপ্ন দেখল। স্বপ্ন দেখল: পালঙ্কের ওপর মার মৃতদেহ, পায়ের কাছে বিনুমাসি, মার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে; মার মাথার কাছে নির্মলা চুপচাপ বসে, মার মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে; আর পালঙ্কের মাঝামাঝি জায়গায় বাবা দাঁড়িয়ে। বাবার হাতে মস্ত বড় একটা রংমশাল–অনেকটা বাবার শখের কাশ্মীরি ছড়ির মতন; রংমশালটা জ্বলছে– তার মুখ থেকে রূপোলি ফুলকি, উজ্জ্বল আভা ঝরে পড়ছে। রংমশালের আলোয় মার সর্বাঙ্গ দেখা যাচ্ছিল; মুখ এবং গলা ছাড়া মার সবই আবৃত ছিল। গলায় নীল একটা চওড়া দাগ, কালসিটের চিক-হার পরে যেন মা ঘুমোচ্ছে।
স্বপ্নটা চকিতে দেখা দিয়েই যেন মিলিয়ে গেল। তন্দ্রাও কেটে গিয়েছিল। সুরেশ্বর অন্ধকারে চোখ চেয়ে আর কিছু দেখতে পেল না।
মার স্বপ্ন অনেক দিন দেখেনি সুরেশ্বর। আজ মাকে দেখতে পেয়ে তার খুব ভাল লাগছিল। যেন হঠাৎ সে বাল্যকালে ফিরে গিয়েছিল এবং বালকের মতন মার পালঙ্কের দিকে ছুটে যাচ্ছিল; কাছাকাছি এসে সুরেশ্বর বুঝতে পারল এবং দেখতে পেল, মা পালঙ্কে শুয়ে নেইমার মৃতদেহ শোয়ানো রয়েছে। সে আহত হল। পরে সুরেশ্বর একে একে নির্মলা, বিনুমাসি এবং বাবাকে দেখতে পেল। দেখার পর সে আর বালক থাকল না, আবার বয়স্কমানুষ হয়ে গেল।