ভাল লাগল না অবনীর। এসব চিন্তা তার ভাল লাগে না। তেমন করে দেখলে মানুষ, এই মুহূর্তে যা পায় তার অনেক কিছুর হিসেবই তবে করতে পারবে না। সুখেরও নয়, দুঃখেরও নয়। হীরালাল মারা যাচ্ছে এই সংবাদে সে সেদিন যতটা বিচলিত হয়েছিল আজ আর ততটা নয়। তা হলে তার দুঃখ ক্ষোভ কি জলের হিসেবে মাপা হবে।
সুরেশ্বর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, আপনাদের কাজ কতদূর এগুল?
চলছে, অবনী অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল।
কে যেন সেদিন বলেছিল, এ দিককার কাজ প্রায় শেষ।
কোথায় শেষ, এখনও অনেক বাকি। অবনী বলল, তারপর কী মনে পড়ায় হেসে বলল, যে কাজ এরা হাতে নিয়েছে তা অশেষ।
সুরেশ্বর হাসল। হৈমন্তী হাসল না, মুখ ফেরাল।
অবনী পরিহাস করে বলল, কাজ শেষ হয়ে গেলে আমায় বেকার হতে হবে। তখন আপনাদের শরণাপন্ন হব। বলে হৈমন্তীর দিকে তাকাল।
হৈমন্তী সহাস্য সকৌতুক মুখ দেখল অবনীর। যে-কোনও কারণেই হোক সামান্য আগে আবহাওয়া কেমন গম্ভীর হয়ে এসেছিল, এখন বেশ হালকা হয়ে আসছে। হাসির মুখ করল হৈমন্তী।
সুরেশ্বর হেসে বলল, আমাদের এখানে অন্ধরা আসে, আপনি তো অন্ধ নন।
না; তবে হতে কতক্ষণ?
কথাটা বলার পর অবনী কোথাও যেন কিঞ্চিৎ সন্দেহ অনুভব করল। সুরেশ্বরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হৈমন্তীর দিকে তাকাল। কয়েক পলক যেন তার কেমন এক রহস্যময় অনুভূতির মধ্যে কাটল।
এদিকে কি অন্ধটন্ধ বেশি? অবনী হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
পুরোপুরি যাকে অন্ধ বলে তা হয়তো তেমন নেই, তবে চোখের রোগটা বেশি।
কেন?
অযত্ন, দারিদ্র্য, অবহেলা…। আপনি এদের গাঁয়েটায়ে গেছেন কখনও?
না।
যে ভাবে থাকে সেটা স্বাস্থ্যকর নয়। …
সুরেশ্বর অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার সাধারণ এক উদাহরণ বোঝাতে গিয়ে জানাল, এদিকের সকলেই জ্বালানির জন্যে কাঠকুটো ব্যবহার করে। কাঠের বিশ্রি ধোঁয়া পাখির খোপের মতন খাপরার ছোট্ট ঘরে কত ঢুকছে তা ওরা দেখে না। চার ছ মাসের বাচ্চা থেকে ছেলেমেয়ে বউ সবাই সেই ধোঁয়া খাচ্ছে রোজ। চোখের পক্ষে এটা খারাপ। …এদের বাচ্চাকাচ্চাগুলো সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখে জল পর্যন্ত দেয় না। …এ সবই কিছুটা সাধারণ স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপার। ওরা জানে না, গা করে না। চোখে সামান্য কিছু হলে সেটাকে হাতুড়ে-বিদ্যে করে আরও বাড়িয়ে ফেলে। …
অবনী অন্যমনস্কভাবে শুনল খানিকটা; কোনও উৎসাহ বোধ করল না।
সামান্য সময় নীরবতার মধ্যে কাটাল। অবনী সিগারেটের টুকরোটা নিবিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। দেখতে দেখতে জ্যোৎস্না এ পাশে বারান্দার গায়ে এসে পড়েছে।
সুরেশ্বর বলল, একটু বসুন, আমি আসছি।
সুরেশ্বর ঘরে গেল। হৈমন্তী জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে বসে, অবনীও সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল।
কিছু সময় কেউ কোনও কথা বলল না। শেষে অবনীই কথা বলল। সহাস্য গলায় শুধোল, আপনার আবাস কোনটা?
ভেতরে ঢুকেই ডান দিকে; ছোট মতন বাড়িটা।
যাবার সময় দেখব। ..ও, আচ্ছা…আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি–ডকটরস ওপিনিয়ান আমার আজকাল মাঝে মাঝেই মাথা ধরে। চোখ খারাপ হচ্ছে নাকি?
হৈমন্তী অবনীর চোখে চোখে তাকাল। মুখ দেখে বোঝা যায় না ঠাট্টা-তামাশা করছে না সত্যি সত্যিই কিছু জানতে চাইছে। হৈমন্তী প্রায় পেশাদারি গলায় বলল, আপনার চোখ কি খারাপ?
না; দেখতে কোনও অসুবিধা হয় না।
পড়তে? পড়াশোনার কাজকর্ম করতে?
না।
তা হলে কিছুনয়, হৈমন্তী বলল। বলেই ভাবল: বেশি মদটদ খাওয়ার জন্যেও হতে পারে হয়তো। অবনী সম্পর্কে সে কেন যেন সামান্য বিরক্তি বোধ করল এখন।
না হলেই ভাল অবনী হাসল, চারদিকে এত রকমের অন্ধ দেখে ভয় হয়।
কথাটা শুনতে সাদামাটা; কিন্তু অবনী এমনভাবে বলল যে হৈমন্তীর সন্দেহ হল কথাটার মধ্যে দ্বিতীয় অর্থ আছে, খোঁচা আছে। ঠিক কী বোঝাতে চায় অবনী হৈমন্তী জানতে চাইল, এবং জানার আশায় অবনীকে লক্ষ করল।
অবনী নিষ্পলকে হৈমন্তীকে দেখছিল। দৃষ্টি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল অবনী যেন হৈমন্তীর মধ্যে কিছু খুঁজছে, কিছু বা বলছে। হৈমন্তী চোখ সরিয়ে নিল।
অবনী গলার স্বর নামিয়ে বলল, আপনারা দুজনেই খুব ডিভোটেড?
হৈমন্তীর মনে হল, অবনী দুজনে শব্দটা ইচ্ছাকৃত জোর দিয়ে বলল, বিশেষার্থে যেন। কী বোঝাতে চাইল? সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর একটা যুগ্মসম্পর্ক কী সে গড়ে নিয়েছে। কেন যেন অবনীর এই ধারণা তার ভাল লাগল না।
হৈমন্তী বলল, আমি নয়; উনি।
আপনি?
..ভেবে দেখিনি।
সুরেশ্বর ফিরে এল।
সুরেশ্বর ফিরে এসে বসতে না বসতে যুগলবাবুকে দেখা গেল। বাগানের মধ্য দিয়ে এলেন। হাতে কিছু খাতাপত্র। সিঁড়িতে পা দিলেন।
হৈমন্তী অবাক। যুগলবাবু কি আজ বাড়ি ফেরেননি। বলেছিলেন অবশ্য, আজ অনেক কাজ আছে, আশ্রমের অফিসের কাজ, হিসেবপত্রের ঝঞ্জাট। হৈমন্তী বুঝতে পারল, কাজের চাপে আজ ওঁর বাড়ি ফেরা হয়ে ওঠেনি, এখানেই থেকে গেছেন।
যুগলবাবু বারান্দায় উঠে অবনীকে দু পলক দেখলেন। সুরেশ্বরের সঙ্গে তাঁর কাজ, অথচ এখন খাতাপত্র খুলে বসা যাবে কি না সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহ হল যেন।
সুরেশ্বরও সামান্য বিব্রত বোধ করে অবনীর দিকে তাকাল।
যুগলবাবু বললেন, তিনি কি আর একটু পরে ঘুরে আসবেন?
সুরেশ্বর কিছু বলার আগেই অবনী বলল, আপনারা বোধহয় কাজে বসবেন?
সুরেশ্বর মাথা নাড়ল, হ্যাঁ কিছু অফিস সংক্রান্ত জরুরি কাজ। …আপনি…