.
০৮.
সুরেশ্বরের বাড়ির বারান্দায় ওরা বসে, লণ্ঠন জ্বলছে, ছোট মতন জলচৌকির ওপর চায়ের কাপ। হৈমন্তীকে দেখে অবনী সৌজন্য প্রকাশ করে তার চেয়ার ঠেলে সামান্য উঠে দাঁড়াল, বলল, আসুন।
হৈমন্তী ঠিক নমস্কার করল না, মাথা নিচু করে যেন তার তরফ থেকে ভদ্রতা প্রকাশ করল; পরিচয়ের স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলল, আপনি বসুন।
সুরেশ্বর আশেপাশে তাকিয়ে হৈমন্তীর বসার জায়গা খুঁজছিল, হৈমন্তী একটা কাঠের চেয়ার টেনে নিল। বসল। অবনীও বসেছে।
সুরেশ্বর বলল, কোন দিকে বেড়াতে গিয়েছিলে?
নদীর দিকে, হৈমন্তী মৃদু গলায় জবাব দিল।
চুপচাপ। সুরেশ্বর অবনী কোনও বিষয়ে কথা বলছিল, হৈমন্তী ওদের গলার শব্দ শুনেছে, এখন হৈমন্তী আসায় ওরা থেমে গেছে। অবনীর দিকে তাকাল হৈমন্তী, কতক্ষণ এসেছেন?
অনেকক্ষণ। ঘন্টা খানেকেরও বেশি।
দেখলেন সব… হৈমন্তী মুখে হাসি মাখিয়ে বলল।
মোটামুটি।
কেমন লাগল?
অবনী কেমন অপ্রস্তুত বোধ করে সুরেশ্বরের দিকে তাকাল। সুরেশ্বর যেন হাসছিল।
সুরেশ্বর বলল, উনি তেমন করে কিছু দেখেননি, হেম। আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করার সময় একটু পায়চারি করলেন।
অবনী সঙ্কোচ অনুভব করে বলল, না, ঠিক তা নয়; এখন আর কী দেখব! পরে আবার একদিন আসা যাবে।
হৈমন্তীর মনে হল, আশ্রম দেখার উৎসাহ অবনীর নেই। কী বা দেখবে সে? কটা বাড়ি, কয়েকজন অন্ধ, আর হাসপাতাল? এসব দেখার আগ্রহ কারই বা থাকে।
নিজের কুণ্ঠা ও অপ্রস্তুত ভাব কাটবার জন্যে অবনী ঠাট্টার গলায় এবার বলল, আমরা মিস্ত্রি-মজুর মানুষ, এসব বুঝি না। …কথাটা হৈমন্তীর দিকে তাকিয়েই প্রায় বলল অবনী, তারপর সুরেশ্বরের দিকে তাকাল, তবে আপনি মশাই, কাজের লোক। আমাদের বিজলীবাবু বলেন, কর্মযোগী ব্যক্তি। বলে জোরে জোরে হাসল।
সুরেশ্বরের নীরবে হাসল। হৈমন্তীর ঠোঁটেও হাসি খেলে গেল।
অবনী পকেট থেকে প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল। এক গলা ধোঁয়া টেনে নিয়ে ঢোঁক গিলল। পরে সুরেশ্বরকে লক্ষ করে বলল, আপনি বেশ সুখে-শান্তিতে আছেন দেখছি। …আজকাল সুখটুখ পাওয়া একটা ভাগ্য।
অবনী ঠাট্টা করল নাকি বাস্তবিকই কোনও ক্ষোভ জানাল বোঝা গেল না। হৈমন্তী আড়চোখে অবনীর মুখ দেখল। সুরেশ্বরকে যদি অবনী ঠাট্টাই করে থাকে তবে ভালই করেছে। হৈমন্তী কোথায় যেন তৃপ্তি বোধ করল। ইচ্ছে হল অবনীকে বলে–ওঁর মতন হয়ে যেতে পারলে কোনও আঁচই গায়ে লাগে না, লাগলেও ফোঁসকা পড়ে না–নিশ্চিন্ত থাকা যায়।
সুরেশ্বর শান্ত গলায় হাসিহাসি মুখেই বলল, তা একরকম আছি; সুখের চেষ্টায়… সুখের চেষ্টা কথাটায় ঝোঁক ছিল।
কথাটা অবনী খেয়াল করে না শুনলেও তার কানে গিয়েছিল। হৈমন্তীও শুনেছে। অবনী কোনও কিছু না ভেবেই ঠাট্টাচ্ছলে বলল, বেশ তো রয়েছেন, আবার চেষ্টায় আছি বলছেন কেন!
সুরেশ্বর বলল, আপনি বোধহয় সেই পাখির গল্পটা শোনেননি?
পাখির গল্প শোনার মতন ছেলেমানুষ অবনী নয়। অনাগ্রহের গলায় বলল, না।
এ সংসারে একটা গাছ আছে, তাতে দুটো পাখি থাকে… সুরেশ্বর বলল, একটা পাখি থাকে গাছের মাথায়, অন্যটা নীচে-গাছের ডালে বসে ফল খায়। …আমার যতটুকু সুখ তা নীচের ডালে বসে, ওপরে উঠতে পারি না।
অবনী সুরেশ্বরকে দেখল। হৈমন্তীও লক্ষ করছিল। সুরেশ্বর হেঁয়ালি করলেও করতে পারে, কিন্তু অবনীর মনে হল সে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে।
এ যে মশাই তত্ত্বকথা, অবনী হেসে বলল, আমার মোটা মাথায় ঢুকবে না।
সুরেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিল না। হঠাৎ যেন সে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। সামান্য পরে হৈমন্তীর দিকে তাকাল একবার, তারপর অবনীকে বলল, হেম সেদিন বলছিল সংসারে সবাই সুখ চায়। মিথ্যে বলেনি। আমরা সবাই সুখ চাই, দুঃখ পাবার জন্যে কে আর জগতে বাঁচতে চায়। তবু দুঃখের জগতে দুঃখ আছে। সুখও আছে। কিন্তু সুখের কথা ভাবলে কোথায় যেন সন্দেহ থাকে। আমি দেখি সুখ ওই রকম: একই গাছে দুই পাখি, একটা ওপরে, অন্যটা নীচে। আমাদের বেশির ভাগ মানুষের সুখ নীচের ডালে…
নীচে যে কিছু পাওয়া যায়, ওপরে কিছু না। অবনী অক্লেশে বলল।
আমার তা মনে হয় না, সুরেশ্বর জবাব দিল, ওপরে উঠলে হয়তো আরও বড় কিছু পাওয়া যায়।
কী পাওয়া যায়? ভগবান?
আনন্দ।
কেমন আনন্দ? অবনী শ্লেষের মতন করে হাসল।
তা তো জানি না। যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা বলছেন সমস্ত সংকীর্ণ বেদনা থেকে মুক্ত এ-আনন্দ।
কারা কী বলেছে তাতে কী আসে যায়। তারা মিথ্যে বলতে পারে, ধাপ্পা মারতে পারে। অবনী উপহাস করে বলল। কী পাচ্ছি তার হিসেব না করে কী পাব তার হিসেব করা মূর্খতা। ওসব সুন্দর সুন্দর কথা আমি বিশ্বাস করি না।
সুরেশ্বর উত্তেজিত হল না। স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনি কি মনে করেন আজকের হিসেবটাই সব?
না মনে করার কারণ নেই।
সুরেশ্বর আর কিছু বলল না। যেন এ বিষয় নিয়ে তর্ক করার অভিরুচি বা ইচ্ছা তার নেই, প্রয়োজনও নয়। সামনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল।
হৈমন্তীও বাগানের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। জ্যোৎস্না আরও পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে, লতায়পাতায় চাঁদের আলো মাখানো। অথচ হৈমন্তী তেমন সুখ পাচ্ছিল না। কোথায় যেন এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা রয়েছে।
অবনী হাতের সিগারেট ফেলে দিল। সুরেশ্বরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করার পরই সহসা তার ললিতার কথা মনে পড়ল। কেন? ললিতার কাছে সে যা পেয়েছিল তা স্থায়ী হয়নি বলে, নাকি সেদিন তার হিসেবে গোলমাল হয়েছিল, ভুল হয়েছিল।