নিজের দুর্বলতা এবং দ্বিধা হৈমন্তী লুকোতে চাইল না। বলল, আমরা হিন্দু, মালিনী; আমাদের ধর্মে ঠাকুর দেবতা লোকে বিশ্বাস করে। আমিও করি! .. তা ছাড়া এসব নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। সত্যি মিথ্যে জানি না।
মালিনী কেন যেন খুশি হল। বলল, হেমদি, আমার বাবা বলত: ঘুমন্ত মানুষের ঘরেই চোরে সিদ দেয়, ভাবন্ত মানুষের ঘরেই ভগবান দেখা দেয়। বলে মালিনী কেমন ভাবের ঘোরে গুনগুন করে হিন্দি ভজনের একটা কলি গাইল।
.
আশ্রমের কাছে আসতেই চোখে পড়ল সামান্য দূরে একটা জিপগাড়ি দাঁড় করানো। আশেপাশে কেউ নেই।
হৈমন্তী কিছু অনুমান করার আগেই মালিনী বলল, কে এল?
অনেকটা দূর থেকেও হৈমন্তীর মনে হল সে গাড়িটা চিনতে পেয়েছে। অনুমান করল, অবনীবাবু এসেছেন।
মালিনী তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল, কে এসেছে জানতে সে ছেলেমানুষের মতন ব্যগ্র। হৈমন্তী পিছিয়ে পড়ল।
অবনীর কথা মনে আসতেই মালিনীর সেই কথাগুলো মনে পড়ল: খুব মদটদ খায়, একলা থাকে। মালিনী একেবারে একটি গেজেট। হৈমন্তীর হাসি পেল! ..তা হঠাৎ ভদ্রলোক আজ এখানে এলেন? বেড়াতে? সুরেশ্বর ওঁকে আসতে বলেছিল, তাই নাকি? হৈমন্তীও তো আমন্ত্রণ করেছিল।
জিপগাড়ি দেখে মালিনী ফিরে আসছিল। রোগীদের ঘরের দিকে বারান্দায় এক চোখে ব্যান্ডেজ বেঁধে একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে, পাশে পিছন ফিরে আর একজন কে দাঁড়িয়ে। অন্ধকুটিরের দিকে কয়েকজন মাঠে গোল হয়ে হয়ে বসে। চাকরবাকরও দেখা যাচ্ছিল। ফিরে আসার সময় মালিনী চেঁচিয়ে কাকে কী জিজ্ঞেস করল। ফিরে এসে বলল, কে এক বাবু এসেছে।
অবনীবাবু বোধহয়– হৈমন্তী বলল।
মালিনী চোখ তুলে হৈমন্তীর মুখ দেখল, দুপলক, তারপর নিজের বোকামির জন্যে যেন আফসোস করে বলল, ওমা তাই তো! ঠিক ধরেছেন হেমদি, এ গাড়ি আমি দেখেছি আমাদের ওখানে।
নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়াল হৈমন্তী; মালিনীও হাঁটতে লাগল।
হেমদি–
একটা কথা বলব, রাগ করবেন না?
কী কথা? হৈমন্তীর সন্দেহ হল মালিনী আরও কোনও নতুন খবর শোনাতে চায়।
মালিনী বলল, আপনার সঙ্গে তো চেনা আছে– ওঁকে একটু আমার ভাইয়ের কথা বলবেন। আমার ভাইটা একেবারে গোবাগাবলা; কিছু মুরোদ নেই। ধরলে করলে চাকরিটা আর একটু ভাল হতে পারত, মাইনেও বাড়ত।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। মালিনীর কথায় এমন এক কাতর অনুরোধ ছিল যে, হৈমন্তীর দুঃখই হল। সেদিন মালিনীর কথা শুনে শুনে মনে হয়েছিল–যে মদ খায়, অত বড় বাড়িতে একলা থাকে তার সম্পর্কে মালিনীর যেমন ভয় তেমনি বিতৃষ্ণা, হয়তো ঘেন্নাও। এখন মালিনীর কথা শুনে মনে হবে, ভদ্রলোক মদই খান আর একলাই থাকুন মালিনীর তাতে আসে যায় না; তার যত বিতৃষ্ণা, ভয়, ঘৃণাই থাকুক তবু সে জানে ওই ভদ্রলোক ইচ্ছে করলেই মালিনীর ভাইকে তরিয়ে দিতে পারেন। এই বিশ্বাসও, হৈমন্তীর হঠাৎ যেন মনে হল অদ্ভুত, প্রয়োজনে বিশ্বাস।
মালিনী অপেক্ষা করছে দেখে হৈমন্তী বলল, আমার সঙ্গে আর কতটুকু চেনা? হুট করে কি ও-সব কথা বলা যায়। বরং তুমি ওঁকে বলতে বলো।
কাকে?
তোমাদের দাদাকে। ..ওঁর সঙ্গেই বেশি চেনা।
মালিনী মাথা নাড়ল, নানা, দাদাকে এসব কথা বলা যায় নাকি! আপনি যেন কী হেমদি!
মালিনীর জন্যে কেমন সহানুভূতি বোধ করল হৈমন্তী, বলল, আচ্ছা দেখি।
দরজার মাথায় শেকল খুলে হৈমন্তী নিজের ঘরে ঢুকল, মালিনী গেল তার ঘরে।
অন্ধকারে কয়েক দণ্ড দাঁড়িয়ে থাকল হৈমন্তী। মালিনী হাত মুখ ধোবে, সন্ধে দেবে, লণ্ঠন জ্বালবে; ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে হৈমন্তীকে।
অবনীবাবু এসে সুরেশ্বরের কাছে বসে রয়েছেন নিশ্চয়, গল্পগুজব করছেন। সেখানে যাওয়া কি তার উচিত? ভদ্রতা রক্ষা করতে হলে একবার যাওয়া দরকার। সেদিন এই অবস্থায় পৌঁছে দিলেন, আবার পথে যেদিন দেখা হল দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বললেন, এগিয়ে দিলেন খানিকটা, হৈমন্তী ওঁকে আশ্রমে আসতে অনুরোধ করল। এর পর, ভদ্রলোক আজ যখন আশ্রমে এসেছেন তখন তাঁর সঙ্গে দেখা না করাটা কি ভাল দেখাবে! না দেখা করাটা সৌজন্য হয় না। আবার সুরেশ্বরের ওখানে গিয়ে দেখা করাটাও কেমন যেন!
সুরেশ্বরের সঙ্গে ভদ্রলোক কী গল্প করছেন তাও জানার কৌতূহল হল হৈমন্তীর; প্রথম দিনই, জিপগাড়িতে আসার সময় পরস্পরের কথাবার্তা শুনে হৈমন্তী বুঝতে পেরেছিল, দুটি মানুষই দুরকম, কোথাও কোনও মিল আছে বলে মনে হয় না। এই আশ্রম সম্পর্কে যে অবনীর কোনও আস্থা নেই, বরং সুরেশ্বর ও এই আশ্রম সম্পর্কে তার মনোভাব উপহাসের তা বোঝা যায়। হৈমন্তীর কানে অবনীর সেই বিদ্রূপ ধরা পড়েছে। ..দুই বিপরীত প্রকৃতির মানুষ মুখোমুখি বসে কী গল্প যে করছে তা শোনার কেমন এক অদ্ভুত বাসনা হল হৈমন্তীর।
মালিনী বাতি দিয়ে গেল।
হৈমন্তী কলঘরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে বলল, আমায় একটু জল খাওয়াও মালিনী, আমি আসছি।
মুখ হাত ধুয়ে ফিরে এসে হৈমন্তী শাড়িটা একটু গোছগাছ করে নিল, মুখ মুছল পরিষ্কার করে, হালকা করে পাউডার বুলিয়ে নিল, চুলে একটু চিরুনি ছোঁয়াল, জল খেল। তারপর ঘরের বাইরে এসে শেকল তুলে দিল।
মালিনী বাইরে এসেছিল, শুধোল, কোথায় যাচ্ছেন, হেমদি?
ওবাড়িতে যাই, একবার দেখা করে আসি।
হৈমন্তী মাঠে নামল। ততক্ষণে অন্ধকার হয়েছে। অন্ধকারের মধ্যেই বোঝা গেল চাঁদ উঠছে।