হাঁটতে হাঁটতে মালিনী বলল, মানুষ মরে যাবার পর তার আত্মা কী করে স্বর্গে যায়, হেমদি?
হৈমন্তীর পঠিত বিদ্যার মধ্যে আত্মার স্বর্গগমনের কোনও সংবাদ ছিল না, হৈমন্তী সকৌতুক চোখে এই সরল মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল, হাসির মুখ করল। তা তো জানি না।
মালিনী বোধ হয় জবাবটায় খুশি হল না; তার মনঃপূত জবাব এটা নয়। বলল, এখানে স্টেশনের কাছে একবার একটা বায়স্কোপ এসেছিল, সাবিত্রী সত্যবান পালা আমি দেখেছি। হিন্দি। সত্যবান মারা যাবার পর যমরাজ তার আত্মা নিল জানেন হেমদি। ইস্..কী কষ্ট যে হচ্ছিল, কিন্তু খুব ভাল দেখিয়ে ছিল। যমরাজ তার গদার মতো জিনিসটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সত্যবানের বুকের কাছে ধরল আর সঙ্গে সঙ্গে সত্যবানের শরীর থেকে আর-একটা ছায়ার মতন সত্যবান বেরিয়ে এল; যমরাজ যত তার দণ্ডটা তুলছে, সেই ছায়ার মতন সত্যবানের শরীরটা ছোট হয়ে হয়ে জ্যোতির মতন হয়ে গেল, অবিকল একটা বলের মতন। যমরাজ তার দণ্ড কাঁধে তোলর পর জ্যোতিটা মিলিয়ে গেল, দেখা গেল না। ..
হৈমন্তী বুঝতে পারল না কী বলবে। চুপ করে থাকল।
মালিনী বলল, আত্মা ওই রকম ভাবে চলে যায়। না?
সিনেমায় ওই ভাবে দেখায়।
না হেমদি– মালিনী মাথা নেড়ে প্রতিবাদ জানাল। আমার বাবা যখন মারা গেল আমি বাবার মাথার দিকে দেওয়ালে গোল মতন আলো দেখেছিলাম, ঠিক যেন কেউ আলো ফেলেছে দেওয়ালে। তারপর কান্নাকাটি করছিলাম তো, আর কিছু দেখিনি।
হৈমন্তীর ইচ্ছে হল, বলে, ওটা তোমার চোখের ভুল, মনের ভুল; কিন্তু বলতে কষ্ট হল। মালিনী যদি তার বাবার আত্মাকে আলোর মতন হয়ে মিলিয়ে যেতে দেখে থাকে তবে দেখুক–এখন এই মুহূর্তে তার ভ্রম ভাঙানোর চেষ্টা করলে সে ব্যথিত হবে।
হৈমন্তী চুপচাপ হাঁটতে লাগল। পাশে মালিনী।
মালিনী বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারে না। আবার বলল, আমাদের আত্মাটা কোথায় থাকে, হেমদি? বুকের মাঝখানে?
হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে মালিনীকে দেখল। বলল, আমি জানি না। বলেই কী যেন ভেবে আবার বলল, এসব কথা তোমাদের দাদাকে জিজ্ঞেস কোরো।
সুরেশ্বরকে আত্মার কথা জিজ্ঞেস করার মতন সাহস মালিনীর নেই। মালিনী বলল, না বাবা, দাদাকে কে জিজ্ঞেস করবে।
ভয় করে?
ভয় করবে না…উনি কত রকম জানেন, আমি কোথাকার কী একটা, এসব কথা জিজ্ঞেস করতে পারি নাকি!
করেই দেখোনা, খেয়ে ফেলবে না তো আর।
মালিনী বিন্দুমাত্র উৎসাহ পেল না। আপনিই করবেন, করে আমায় বলবেন।
হৈমন্তী হাসল। আচ্ছা, করব।
সামান্য সময় চুপচাপ। মালিনী আবার বলল, হেমদি, অনেকে বলে–দাদা পুজোআচা করে না, দাদা হিন্দু নয়, খেস্টান-হিন্দু।
হৈমন্তী যত অবাক হল তত মজা পেল। খেস্টান-হিন্দু আবার কী?
কে জানে! আমি ওসব বুঝি না। তবে আছে।
কোথায়?
মালিনীর তাও জানা নেই। আমি দেখিনি। তা দাদা হিন্দু না হবে কেন বলুন, হেমদি। দাদা গীতা পড়েন, কী সুন্দর পড়েন–আমি শুনেছি। দাদার ঘরের বাইরে ওই যে বেদিটা আছে ওখানে বসে তিনি ধ্যান করেন, আমি দেখেছি। …দাদার ঘরে রামায়ণ মহাভারত-টারতও আছে।
হৈমন্তীর হাসি পাচ্ছিল, হাসলে মালিনী অপ্রস্তুত হবে, হাসছিল না তাই। তবে সুরেশ্বর তার ঘরের সামনে বেদিতে বসে ধ্যান করে এটা জানা ছিল না। বলল, তোমাদের দাদা কখন ধ্যান করেন? খুব সকালে?
কাক-ভোরেও আমি ওঁকে দেখেছি, সন্ধেতেও।
মন্ত্র পড়েন?
না, চুপচাপ থাকেন। ..আমি কোনওদিন কাছে যাইনি, যাওয়া উচিত না।
হৈমন্তী হঠাৎ বলল, তবে হয়তো চুপচাপ বসেই থাকেন।
না–না, মালিনী জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ওভাবে কেউ বসে থাকে না।
হৈমন্তী আর কিছু বলল না।
কথা বলতে বলতে আশ্রমের কাছাকাছি পৌঁছে মালিনী হঠাৎ শুধোল, আপনি যেন কিছু বিশ্বাস করেন না, হেমদি। ঠাকুর দেবতা মানেন না?
হৈমন্তী জবাব দিতে গিয়ে কেমন দ্বিধায় পড়ল। বলতে পারত, না করি না। কিন্তু সেটা মিথ্যে হত। যদি বলে হ্যাঁ, সেটাও সত্য হয় না। ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস করে সে পুজোপাঠ, উপোস করে না; আবার দুর্গাপুজোয় সে প্রতিমা দর্শন করে, প্রণাম করে, মন্দিরে গেলেও মাথা নোয়ায়, প্রসাদ খায়। বিপদে ও দুঃখে ভগবানকে স্মরণ করে। কলেজে পড়ার সময়ে কত বন্ধুবান্ধবকেই দেখেছে ঠিক এই রকম, দেবমন্দির দেখে প্রণাম করতে, অঞ্জলি দিতে। এমনকী তাদের কলেজের দুজন বাঘা সার্জনকেও সে ছুরি ধরার আগে একবার নীরবে পলকের জন্যে চোখ বন্ধ করে ঈশ্বর স্মরণ করতে দেখেছে। হয়তো এটা সংস্কার; ছেলেবেলা থেকে দেখে দেখে শুনে শুনে এরকম হয়েছে। আচার পালন বা সংস্কার মানা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবু হৈমন্তী অন্তত বলতে পারে না, আমি মানি না। তার জীবনের চরম বিপদের সময় সে কি ভগবানের কথা ভাবত না? প্রার্থনা করত না? অসুখের সময় তার কাছে সর্বক্ষণ আর তো ভগবানের কেউ ছিল না; যা বলার ভগবানের কাছেই বলত।
হৈমন্তীর কেন যেন মনে হল, সে বেশির ভাগ মানুষের মতন আচার ও সংস্কারের বশে ঠাকুর দেবতা মানে, আবার অনেকের মতন সে জানে এর সবই মিথ্যে। নিজের সমাজ, পরিবার, আত্মীয়স্বজন তাকে কিছু কিছু জিনিস বিশ্বাস করতে, ভক্তি করতে শিখিয়েছে; বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা তাকে অনেক বিষয়ে অবিশ্বাসী হতে শিক্ষা দিয়েছে। মালিনী যখন তাকে আত্মার কথা বলল, দেহ থেকে জ্যোতির মতন আত্মা বেরিয়ে যায়, তখন হৈমন্তী অনায়াসে হাসতে পারল। কেন না সে জানে, এরকম হয় না, হওয়া অসম্ভব। অথচ সে কেন হেসে বলতে পারছে না ঠাকুর দেবতা আবার কী! ও-সব লোকে দেখায়, বোঝায়। আমি মানি না। কোথায় যেন একটা দুর্বোধ্য বিশ্বাস তার থেকে গেছে।