এপাশে, নদীর দিকে বেলাবেলি বেড়াতে এলে দুপাঁচজন মানুষও দেখা যায়। গ্রামের মানুষ:নদীর এপারে সবজি অথবা শস্যক্ষেত্রে কাজকর্ম সেরে নদী পেরিয়ে বাড়ি ফিরছে, সাইকেলের পেছনে শূন্য টুকরি বাঁধা ব্যাপারিও দু-একজন গ্রামে ফেরে। নদীর শীর্ণতম স্থানটি দিয়ে পাথরে পা ফেলে ফেলে বালি আর গোড়ালিডোবা জল পেরিয়ে তারা যখন চলে যায় তখন মালিনী বলে, জল আরও কমে যাক, আপনাকে একদিন গাঁয়ে বেড়াতে নিয়ে যাব, হেমদি; ওখানে একটা মেয়ে আছে, একেবারে বাচ্চা কী ফুটফুটে গোবলাগাবলা, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করবে। বেচারি একেবারে অন্ধ। আমাদের এখানে আগে অনেকবার এসেছে। ওর নাকি চোখ আর সারবে না। এত কষ্ট হয়। ..মালিনী ওই গ্রামের আরও পাঁচরকম খবর রাখে: কোথায় একটা মহাদেবের মন্দির আছে, কোন সময়ে ছট পরব হয়, এমনকী একটা অদ্ভুত কুলগাছ আছে, সাদা কুল হয় শুধু–এইরকম অজস্র খবর।
মালিনী এখানে এলে সবসময় পাথরে বসবে, যতক্ষণ বসে থাকবে নদীর জলে পা ডোবাবে। বলে, ওর হাতে পায়ে নাকি খুব জ্বালা। হৈমন্তী কাছাকাছি একটা বড় পাথর বেছে বসে অবশ্য; কিন্তু জলে কখনও পা ডোবায় না, হাতও দেয় না। ইচ্ছে হয় হয়তো, কিন্তু মালিনীর সামনে চাঞ্চল্য প্রকাশ করতে তার সঙ্কোচ হয়, যেন তার বয়সে এবং মর্যাদায় এই ধরনের ছেলেমানুষি করতে বাধে।
সাধাসিধে সরল বলেই মালিনী কথা একটু বেশি বলে। তার কথাবার্তা কখনও কখনও একেবারে বোকার মতন শোনায়, কখনও কখনও মনে হয় সে হৈমন্তীর বন্ধুর মতন হয়ে উঠছে, কী তার বলা উচিত কিবা উচিত নয় তা বুঝতে পারে না। হৈমন্তীর পরিবার সম্পর্কে সে নানান কথা জিজ্ঞেস করে, এই আগ্রহ মেয়েলি কৌতূহল; কলকাতার গল্প, হৈমন্তীর ডাক্তারি লেখাপড়ার গল্প শুনতেও তার ছেলেমানুষের মতন আগ্রহ রয়েছে। ইদানীং হৈমন্তী লক্ষ করছিল, মালিনীর আরও একটি বিষয়ে অস্বাভাবিক কৌতূহল দেখা দিয়েছে, স্পষ্ট করে বা সাহস সঞ্চয় করে কখনও কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারে না, কিন্তু অনেক সময় তার সেই কৌতূহল চাপা ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, ওর দৃষ্টি বহু সময়ে তা ব্যক্ত করে। সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর সম্পর্কের মধ্যে একটি রহস্যের গন্ধ মালিনী পেয়েছে।
মেয়েটিকে হৈমন্তী পছন্দই করে; তবু মালিনীকে সে সমমর্যাদার মানুষ বলে মনে করতে পারে না। বরং মালিনীর বয়স ও অন্যান্য বিষয়ের কথা ভাবলে মনে হয়, ওকে এতটা মেলামেশা করার সুযোগ দেওয়া হয়তো প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আবার, হৈমন্তী কখনও কখনও ভাবে, মালিনীর সঙ্গে তার এমন কিছু তফাত নেই; সে লেখাপড়া শিখেছে, ডাক্তার হয়েছে, মালিনী লেখাপড়া বিশেষ কিছু শেখেনি, বয়সে সে বড়, মালিনী কিছুটা ছোট, হৈমন্তীর শহুরে শিক্ষাদীক্ষা, মালিনীর তা নয়; এ আর কী এমন তফাত। মালিনী তার দাসী নয়, সে ভদ্র পরিবারের মেয়ে, আর্থিক সঙ্গতি আজ তাদের নেই; হৈমন্তীদের কি এক সময়ে খুব একটা আর্থিক সঙ্গতি ছিল! হৈমন্তীর অসুখের সময় সুরেশ্বরের অর্থ সাহায্য কি তাদের প্রয়োজন হয়নি? তবে! ..দরিদ্র বলে মালিনীকে অবহেলার চোখে বা ছোট চোখে দেখতে হৈমন্তী কুণ্ঠিত হত। তার মতন ডাক্তার নয় বলে, বা মালিনী শহুরে নয় বলেও তাকে নিচু করে ভাবতে তার খারাপ লাগত। তবু পুরোপুরি মালিনীকে নিজের সমান সে মনে করতে পারত না।
সঙ্গী হিসেবে, আর অনেকটা যেন দূর আত্মীয়ের মতন হৈমন্তী মালিনীকে গ্রহণ করেছিল। দুটো কথা বলতে, গল্প করতে, মন হালকা করে হাসতে মালিনী ছাড়া তার সঙ্গী নেই। তা ছাড়া, মেয়ে বলেই হয়তো, স্বভাববশে তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, হৈমন্তী তেমন স্বতন্ত্র ও পৃথক থাকতে পারছিল না। হৈমন্তীর এই ধরনের মনোভাবকেই মাঝে মাঝে তার প্রশ্রয় দেওয়া বলে মনে হত। মনে হলেই সে বিরক্ত হত। আবার সময়ে সময়ে তার বিরক্তি নষ্ট হয়ে কেমন কুণ্ঠা জাগত।
নদীর পাড়ে পাথরে বসে কথা বলতে বলতে বিকেল পড়ে গেল। বর্ষা বিগত, শরৎকাল এসে পড়েছে। হৈমন্তী তেমন করে কখনও শরৎকাল কলকাতায় দেখতে পায়নি কিন্তু অসুখের সময় সে বীরভূমের মাঠেঘাটে শরৎকাল দেখেছে, স্মৃতি হয়ে এখনও তা বেঁচে আছে। এখানে সেই শরৎ নেই; কাশফুল চোখে পড়ে না-ধানের ক্ষেতে বাতাসের লুটোপুটি খাওয়া নেই, হাসিকান্নার মতন রোদ বৃষ্টিতে ভেজা তরুলতা কোথায়! তবু এখানেও শরৎকাল এসেছে। আকাশে, মেঘে, রোদে, বন্য প্রান্তরে এমনকী শস্যক্ষেত্রেও তা চোখে পড়ে। এই শরৎ সজল স্নিগ্ধ নয়, শুষ্ক স্নিগ্ধ। বড় তাড়াতাড়ি এখানে সব শুকিয়ে যায়। দীর্ঘ বর্ষার সমস্ত চিহ্ন এখানে অতি দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছিল, যেন নতুন পালা শুরু হওয়ার আগে কেউ দক্ষ হাতে তাড়াতাড়ি পুরনো পালার সব কিছু মুছে নতুনের জন্যে রঙ্গমঞ্চ সাজিয়ে দিচ্ছিল।
বেলা পড়ে আসছিল। এক ঝাঁক পাখি নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেল। গোধূলির মতন আকাশ কোথাও কোথাও রক্তাভ।
হৈমন্তী উঠল। মালিনীর ইচ্ছে ছিল আরও একটু বসে। আজ সে হৈমন্তীর কাছে নানারকম মজার গল্প শুনছিল। গল্পে গল্পে হৈমন্তীর ডাক্তারি পড়ার গল্প উঠেছিল: প্রথম প্রথম মড়ার গন্ধ কেমন লাগত হৈমন্তীর, কী কী করতে হত।
জল থেকে পা উঠিয়ে নিয়েছিল মালিনী অনেক আগেই, ওঠার সময় নদীর জলে মুখ ধুলো, কুলকুচো করল, তারপর আঁচলে হাত মুছে উঠে পড়ল।