অকারণে, অল্প কারণে, কখনও বা ইচ্ছাকৃত ভাবেই ঝগড়া করত ললিতা। অবনী অন্তত তাই ভাবত। আবার ললিতা ভাবত অবনীই সব দোষে দোষী। অবনী ললিতার মধ্যে শিক্ষা রুচি শালীনতা কর্তব্যজ্ঞান সংসারের প্রতি টান খুঁজে পেত না। মেয়েটাকে ও ছোটবেলা থেকেই নষ্ট করেছে, তার স্বভাব খারাপ করে দিচ্ছে।
ললিতা ভাবত, অবনী তাকে ঠকিয়েছে; চাতুরি করে–কৌশলে ললিতাকে তার সংসারে এনে আটকে ফেলেছে। তার স্বাধীনতা, পছন্দ বলে এখন আর কিছু নেই।
ললিতার স্থির ধারণা হয়ে গিয়েছিল, অবনী তাকে প্রবঞ্চনা করেছে। কী ধরনের প্রবঞ্চনা তা সে তেমন বুঝত না; তবে মনে হত–এ-রকম জীবন সে চায়নি, আর পাঁচজন মেয়ের মতন ঘরদোর, স্বামী, মেয়ে এইসব নিয়ে তাকে দিন কাটাতে হবে, ভাবতেই তার বিশ্রী লাগত, ঘৃণা হত। অবনী তাকে সেই একঘেয়েমির মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছে। তা ছাড়া অবনী, ললিতার মনে হত, তাকে ভালবাসে না, তার প্রতি মমতা নেই, মর্যাদাও দেয় না। শুধুমাত্র বিছানায় নিয়ে শোবার জন্যে তাকে বিয়ে করেছিল। লোকটা চতুর এবং কামুক।
তোমার টান তো শুধু এক জায়গাতেই। ফুর্তির জন্যে যখন দরকার, যেটুকু দরকার। ললিতা বলত।
তোমার কত জায়গায় টান-অবনী বিদ্রূপ করে জবাব দিত।
নেই। কেন থাকবে। আমি কি এইসব চেয়েছিলাম?
চাওনি। তুমি কী চেয়েছিলে আমি এখন তা বুঝতে পারি।
কী শুনি?
এখানে দুদিন সেখানে দুদিন করে কাটাতে; মজা লুটতে। যার কাছে যতদিন লোটা যায়।
কত মজাই তোমার কাছে পেলাম। ললিতা উপহাস করে বলত।
আসলে অবনী ও ললিতার মধ্যে স্বভাবের পার্থক্য ছিল প্রচুর। তারা নিজেদের প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পর্কে চিন্তা করে একে অন্যের কতটা নিকট হতে পারবে তা ভাবেনি। একমাত্র শয্যাই তাদের মিলনক্ষেত্র ছিল, অন্যত্র তারা বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র থাকত। যে অনুভব, বোঝাপড়া, সহিষ্ণুতা এবং স্বার্থত্যাগ থাকলে তারা পরস্পরের বিপরীত স্বভাবকেও সহ্য করে নিতে পারত, সহ্য করে পরস্পরকে ক্রমশ পরিবর্তিত ও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ এবং একাত্ম করতে পারত–তেমন বোঝাপড়া, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি তাদের কিছুই ছিল না।
অবনী অবসাদ বোধ করতে লাগল। ললিতাও যেন পালাতে পারলে বাঁচে। অবনী লক্ষ করত, ললিতা বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, তার পুরনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা সেরে অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে, অবনীর দিকে চোখ ফেরায় না। সংসার খরচের টাকা মুড়িমিছরির মতন খরচ করে, নষ্ট করে, আবার চায়। কুঠা নেই, লজ্জা নেই।
অবনীর একটিমাত্র দুর্বলতা ছিল। কুমকুম। কুমকুমকে তার মার হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা অবনী করেছিল। ললিতা তা দিল না। বরং সে কুমকুমকে অবনীর বিপক্ষে দাঁড় করাল। বাবাকে ঘৃণা করতে, অপছন্দ করতে, অবজ্ঞা করতে কেমন করে শেখাল ললিতা কে জানে, কিন্তু কুমকুম তার মার দলে চলে গেল। ওইটুকু মেয়ের চোখে অবনী যে বিষাক্ত দৃষ্টি দেখেছে তাতে মনে হয়েছে, সংসারে তার মতন পাকা শয়তান যেন আর নেই।
ললিতা মেয়েটাকে একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছিল। তাকে শত রকমের ইতরতা শেখাচ্ছিল। অবনীর মনে হয়েছিল, ললিতা তাকে দুর্বল স্থানে আঘাত করে আনন্দ পেতে চাইছে।
একদিন ললিতা বলল, এভাবে আমি থাকব না।
কী ভাবে?
তোমার সঙ্গে কোনও মেয়ে থাকতে পারে না।
আর কেউ তোমায় পুষতে চাইছে নাকি?
ভদ্রলোক হবার শিক্ষা যে পাওনি তা তো আমার জানা আছে।
তোমার পরিবারের লোকজন কি ভদ্র?
তোমার চেয়ে ভদ্র।
দেখতেই পাচ্ছি। …বাপ কুকুর-ব্রিড করিয়ে পয়সা নেয়, ছেলে নাচের দলে মেয়ে সাপ্লাই করে, এক বোন তো…
তোমার মা বাবাও দেবতার অংশ নয়। ওসব কথা থাক, নিজের গায়ের গন্ধ যখন লুকোতে পারবে না তখন অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ কী! ..আমি ঠিক করেছি–তোমার এখানে আমি থাকব না।
কার সঙ্গে থাকবে?
দরকার হলে কারুর সঙ্গে থাকব।
আজকাল মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে থাকছ নাকি?
আমি ডিভোর্স চাইব।
চাও।
তুমি রাজি?
আপত্তি নেই। …পরে ভেবে দেখব।
মেয়ে আমার কাছে থাকবে।
না। মেয়ে আ
মার। তোমার কাছে আমি তাকে থাকতে দেব না।
পারিবারিক জীবনে যেমন, বাইরেও অবনী সেই রকম অসুখী অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল। অফিসে তার সঙ্গে বন্ধুবান্ধব সহকর্মীর মনোমালিন্য ঘটছিল। ওপরঅলার সঙ্গে বিরোধ। তার আর কিছু ভাল লাগত না, সহ্য হত না। সব বিষয়েই তার অসীম ক্লান্তি জমছিল, অনাগ্রহ বাড়ছিল। মনে হত সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, অবসন্ন ও ক্লান্ত বোধ করছে। কেমন যেন এক একঘেয়েমি, অর্থহীনতার মধ্যে সে বেঁচে আছে, উদ্দেশ্যবিহীন জীবন, কোথাও কোনও স্বাদ নেই সুখ নেই।
একদিন মদ খেতে খেতে কমলেশ বলল, তুই খুব সিক হয়ে পড়েছিল।
শরীর দেখে বলছিস?
না, তোর চোখ মুখ দেখে, কথাবার্তা শুনে।
কিছুই ভাল লাগে না…
সাফারিং ফ্রম বোরডোম।
জানি না। … আমি মাঝে মাঝে ভাবি: আগুনটা এবার নিবে আসছে।
আগুন? কিসের আগুন?
উনুনের। …চল্লিশ বছর বয়েস হয়ে গেছে, বুঝলি। আজকের দিনে চলিশ বছর বেঁচে থাকা খুব ডিফিকাল্ট। …আমার মতন ব্যাসটার্ডের ধুনি কতকাল জ্বলবে।
বুঝতে পারছি, এই বেলা কেটে পড়।
শেষ পর্যন্ত অবনী সত্যিই চলে এল। ললিতাকেও ছেড়ে দিল, মেয়েকেও। কিন্তু অবনী বুঝতে পারছিল না, জালের বাইরে এসেও সে এ-স্বপ্ন কেন দেখল?
.
০৭.
নদীর দিকে আজ বেড়াতে বেরিয়েছিল হৈমন্তী। সঙ্গে মালিনী। নদীতে এখনও বর্ষার জল রয়েছে। এখানে ওখানে পাথর। স্রোতের কোথাও তাই সামান্য আবর্ত; জলে টান আছে, মৃদু শব্দ রয়েছে, নয়তো এই পাথর আর নুড়িভরা শীর্ণ জলধারাকে নদী বলা যায় না। মাঝে মাঝে মালিনীকে নিয়ে হৈমন্তী এদিকে বেড়াতে আসে। এই নদী যে তার ভাল লাগে তা নয়, তবু আসে। আশ্রম থেকে বেরুলে যাবার রাস্তা মাত্র দুটোই, হয় উত্তরে যাওনয় দক্ষিণে; উত্তরে কাঁচা রাস্তা ধরে গেলে সোজা বাস-রাস্তার মোড় লাটুঠা; দক্ষিণে হাঁটলে অল্প পথ এগিয়ে এই নদী,নদী পেরুলেই গুরুডিয়ার গ্রাম। আশ্রমের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে, বা প্রত্যহ কাঁচা সড়ক ধরে উত্তরে এগুতে ভাল লাগে না বলেই নদীর দিকে আসা। নদীর দিকে আসতেও রোজ ইচ্ছে করে না। তবু, এপাশে এলে, নদীর পাড়ে পাথরে গিয়ে বসলে মনে হয়– এখানে একটু চঞ্চলতা রয়েছে, মৃদু হলেও শব্দ বলে কিছু আছে; উত্তরের দিকে কিছু যেন আর নড়ে, সেই পথ, সেই মাঠ, গাছ, আকাশসমস্তই স্থির; কাল যেমন ছিল আজও সেইরকম আছে, আগামীকালও থাকবে।