এমন তো হতে পারে–হৈমন্তী ভাবল: সুরেশ্বর অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। এখানে হৈমন্তীর কোনও আত্মীয়স্বজন নেই, সে একা; সুরেশ্বরই তাকে এই জঙ্গলের দেশে আনিয়েছে, কাজেই হৈমন্তীর প্রতি তার দায়দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ আছে। সুরেশ্বর সেই দায়দায়িত্ব বোধের জন্য তার অভিভাবক, এবং সেই হিসেবে হৈমন্তীর প্রতি লক্ষ রাখে।
কিন্তু, হৈমন্তী ভেবে পেল না, এটা কী ধরনের অভিভাবকত্ব যে তার ব্যক্তিগত বিষয়ের ওপর সুরেশ্বর নজর রাখবে? হৈমন্তী ছেলেমানুষ নয়, বা সে সুরেশ্বরের আশ্রয়াধীন নয় যে, সুরেশ্বর তার হাঁটাচলা বেড়ানো অথবা কারও সঙ্গে মেলামেশার ওপর চোখ রাখবে।
মনে মনে যে কৌতুকের ভাব এসেছিল সামান্য আগে সে ভাব আর থাকল না হৈমন্তীর। বরং সে বিরূপ হয়ে উঠল আবার। মানুষটা নোংরা হতে পারে না, তার মনে নিশ্চয় সন্দেহ বা ঈর্ষা থাকতে পারে না; থাকলে হয়তো ভালই হত। আসলে হৈমন্তীর ওপর সুরেশ্বর এক ধরনের কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব দেখাতে চায়। বোঝাতে চায়, সে হৈমন্তীর অভিভাবক, তার ভালমন্দের মালিক। …চিন্তাটা বিশ্রী লাগল, এবং হৈমন্তী হঠাৎ সুরেশ্বরের ওপর তীব্র ঘৃণা অনুভব করল। তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ইচ্ছা, রুচি, মনের ওপর অন্ধ আশ্রমের মালিকের মালিকানা স্বত্ব থাকবে নাকি? আমায় কী তুমি তোমার আশ্রমের ঘরবাড়ি, তাঁত, ঝি চাকর পেয়েছ? নাকি তুমি ভেবেছ আমি বোকার মতন তোমায় বিশ্বাস করে এসেছিলাম বরাবর, ভালবেসেছিলাম তার জোরে তুমি আমার জীবন-মরণের প্রভু হয়ে গেছ?
মাঠের ওপর দিয়ে কিছু ধুলো উড়ে এল, কিছু শুকনো পাতা। সামনে লাটুঠার মোড়। হৈমন্তী হঠাৎ কেমন জোরে জোরে হাঁটতে লাগল, কপালের দুপাশ বেশ গরম। সূর্য একেবারে মুখোমুখি। মাথায় রোদ লাগছিল বলে হৈমন্তী এই ফাঁকায় মাথায় কাপড় টেনে হাঁটছিল, এবার কাপড়টা ফেলে দিল মাথা থেকে।
দূরে বাস আসছে। সময় মতন পৌঁছে গেছে হৈমন্তী। হঠাৎ হৈমন্তীর অদ্ভুত একটা কথা মনে এল। যদি আজ সে অবনীর বাড়ি থেকে না ফেরে কী করবে সুরেশ্বর? কী সে করতে পারে…?
.
১৮.
অবনী বলল, আসুন; আমার মনে হচ্ছিল আজ আপনি আসবেন।
অবনীর সহাস্য মুখ সরল দৃষ্টি লক্ষ করতে করতে হৈমন্তী সিঁড়ির শেষ ধাপ উঠে বারান্দায় পা দিল। কী করে মনে হল আমি আসব?
ইনট্যুশান! অবনী হেঁসে হেসেই বলল।
বারান্দায় বসা যেত, কিন্তু বেশিক্ষণ বসে থাকা যেত না। এখন বিকেল শেষ হয়ে এসেছে, এখুনি দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে যাবে, শীত আর বাতাস গায়ে ফুটবে। হৈমন্তী বারান্দায় দাঁড়াল। বলল, আমি বাজারে নেমেছিলাম, ব্যাটারি-ট্যাটারি কেনার ছিল। বলে হৈমন্তী মুহূর্তের জন্যে থামল, অবনীর চোখ দেখল, তারপর হেসে বলল, সেখানে আপনার মহিন্দরকে দেখলুম, সাইকেল চেপে আসছে।
অবনী সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নাড়ল। আরে, না না, মহিন্দর আমায় কিছু বলেনি, আমি জানিই না সে বাজার গিয়েছিল।
হৈমন্তী এবার চোখের একটু ভঙ্গি করল। তাহলে তো আপনার ইনচ্যুশানে বিশ্বাস করতেই হয়।
হাসির মুখ করল দুজনেই।
অবনী বলল, আজ আমি একবার ওদিকে যাব ভেবেছিলাম। তারপর কেমন মনে হল আপনি আসতে পারেন।
ভেবেছিলেন যখন তখন যাবেন– হৈমন্তী সুমিষ্ট করে হাসল। আমার বই ফুরিয়ে গেছে– হৈমন্তী এমনভাবে বলল যাতে মনে হয় এই ফুরিয়ে গেলে তার না এসে উপায় কী। অবশ্য এই বলাটা তেমন কৈফিয়তের মতন শোনাল না।
অবনী বলল, এত তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলেন কেন?
কেন?
এ-ভাবে পড়লে আমি আর বেশিদিন বই জোগাতে পারব না।
সে পরের কথা–।
আপনি আর-একটু রয়ে-সয়ে পড়বেন, অবনী হেসে বলল, কিন্তু এমনভাবে বলল, যাতে বোঝা যায় তার কথার মধ্যে একটা সকৌতুক ইঙ্গিত আছে। অর্থাৎ অবনী যেন পরিহাস করে বোঝাতে চাইল, অত তাড়াতাড়ি সব বই শেষ হয়ে গেলে হৈমন্তী আর কী এবাড়ি আসবে।
হৈমন্তী কথাটায় কান দিল কি দিল না বোঝা গেল না।
বসার ঘরে এসে বসল হৈমন্তী। বাতিটা জ্বালিয়ে দেবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতে অবনী জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সুরেশ্বরবাবুর খবর কী?
হৈমন্তী প্রথমে কোনও জবাব দিল না, পরে উদাসীন গলায় বলল, ভাল।
অবনী হৈমন্তীর দিকে তাকিয়েছিল। বলার ভঙ্গিটা তার কানে গেল। বাইরে তাকাল; শীতের অপরাহু গত, কোথাও রোদ নেই, আলোর সামান্য আভাস এখনও আছে, গাছপাতা প্রায় কালচে হয়ে এল, ছায়া গাঢ় হয়ে ময়লা রং ধরে যাচ্ছে। এই সময়টা অবনীর চোখে সব সময়ই বিষঃ লাগে, বিশেষ করে যখন একা একা থাকে একা একা দেখে। হৈমন্তীর কথা থেকে অবনীর মনে হল, জবাবটা খুব নিস্পৃহ; আগে এভাবে জবাব বড় দিত না হৈমন্তী, এখন দেয়; এখন সে আশ্রম সম্পর্কে বিরক্তি বা উদাসীনতা অবনীর কাছে জানাতেও দ্বিধা বোধ করে না। কিন্তু সুরেশ্বর সম্পর্কে বেশির ভাগ সময়ই হৈমন্তী নীরব থাকে, যা যা বলে তার মধ্যে উৎসাহ বা অনুৎসাহ কিছু থাকে না। এই মুহূর্তের ভাল বলাটা ঠিক নৈর্ব্যক্তিক নয়; কোথায় যেন একটা বিরক্তি ছিল বলার স্বরে ও ভঙ্গিতে।
অবনী বলল, বিজলীবাবু পরশুদিন গিয়েছিলেন না! কথাটা আগের কথার সঙ্গে সম্পর্কহীন। ইচ্ছে করেই অবনী অন্য প্রসঙ্গে কথা শুরু করল।
হ্যাঁ, ওঁর স্ত্রীকে দেখাতে।
চোখে কী হয়েছে বলছিলেন–