.
গত কয়েকটা দিনই হৈমন্তীর খুব স্বস্তির মধ্যে কাটছে না। মনের মধ্যে যেন কিছু জমে আছে, রাগ ক্ষোভ বিরক্তি মালিন্য নাকি দুঃখ বা অনুশোচনা তা বোঝা যেত না। নিজের যথার্থ মনোভাব নিজে বেশির ভাগ সময়েই বোঝা যায় না। কখনও হৈমন্তীর মনে হত সে ক্ষুব্ধ ও আহত হয়ে আছে, কখনও মনে হয়তো সুরেশ্বরের সঙ্গে তার বোঝাপড়ার একটা দরকার ছিল, এবং এই চাপা কলহ বা রেষারেষি যেন তার শুরু। মাঝে মাঝে আবার এমনও মনে হত, সেদিন ঝোঁকের মাথায় হৈমন্তী বেশি রূঢ় হয়ে পড়েছিল। অতটা রূঢ় হওয়া তার উচিত হয়নি হয়তো। অথচ নিজের দিক থেকে হৈমন্তী তেমন একটা দোষও খুঁজে পেত না। সেদিন তার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল; মানুষ মাত্রেরই মাথা গরম হয়, এতে লজ্জায় মরে যাবার কী আছে! সবাই তো আর সুরেশ্বর নয়, গাছপাথরের মতন সহিষ্ণু হবে, শান্ত হবে। কিন্তু, সুরেশ্বর ওপর ওপর যতটা ধীরস্থির শান্ত ভাব দেখায় ভেতরে ততটা নয়। সুরেশ্বরের দৃষ্টিতে বিরক্তি এবং রাগ হৈমন্তী সেদিন লক্ষ করেছে। তার কথায় সুরেশ্বর অসন্তুষ্ট হয়েছিল, অপমান বোধ করেছে। হৈমন্তীর সন্দেহ নেই, সুরেশ্বর এই আশ্রমের সকলের কাছে আনুগত্য চায়, সম্মান চায়, না পেলে আত্মমর্যাদায় আঘাত পায়।
এই মর্যাদা হৈমন্তীরও না থাকার কারণ নেই। সুরেশ্বর নিজের মর্যাদার বিষয়ে যদি এত সচেতন হতে পারে, তবে অন্যের মর্যাদা সম্পর্কেও বা কেন হবে না? হৈমন্তীর যথার্থ মর্যাদা কী সে দিতে চায়!
গুরুডিয়ার কাঁচা রাস্তা ধরে লাঠার পথে হাঁটতে হাঁটতে হৈমন্তী এলোমলো ভাবে কথাগুলো ভাবছিল। শীতের এই মরা দুপুরে পথ হাঁটতে তার খারাপ লাগছিল না। আগে একলা একলা এভাবে ফাঁকায় হাঁটতে তার ভাল লাগত না, বা এতটা পথ হাঁটার অভ্যেস তার ছিল না। আজকাল হৈমন্তীর মোটামুটি অভ্যেস হয়ে গেছে। সে হাঁটতে পারে, ভালও লাগে।
সুরেশ্বর তার একা একা স্টেশনে যাওয়া পছন্দ করে না নাকি? কেন? মালিনী তার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে এটাই কি সুরেশ্বরের ইচ্ছে? নাকি আদেশ? তাই বা হয় কেমন করে, যদি হত, মালিনী তার সঙ্গে আজ যেতে পারত। দাদার বড় অনুগত মালিনী, অনুমতি না নিয়ে আশ্রমের বাইরে পা বাড়াতে সাহস করে না। মালিনী অনুমতি নেয়নি বলে যেতে সাহস করল না। শেষ পর্যন্ত যে যেতে চেয়েছিল সেটা বোধ হয় ওই ভয়ে-যদি সুরেশ্বর রাগ করে!
চিন্তাটা কেমন জটিল হয়ে সুতোর জট পাকানোর মতন জড়িয়ে যেতে লাগল। কোনও কোনও সময় ভাবনার ঝোঁক নোংরা হয়ে ওঠার উপক্রম হচ্ছিল। সুতোর জট হাতে করে খুলতে গিয়ে খুলতে না পারলে বার বার চেষ্টায় যেমন আঙুলের ময়লা লেগে কোনও কোনও জায়গা কালচে হয়ে আসে সেই রকম নানাভাবে চিন্তাটাকে ছাড়াতে গিয়ে কোথাও কোথাও মনের ময়লা লাগছিল। হৈমন্তীকে সর্বক্ষণ ছায়ার মতন অনুসরণ করতে বলার মতন মন সুরেশ্বরের নয়। স্টেশনে সে মাঝে মাঝেই যাচ্ছে বলে সুরেশ্বর মালিনীকে হৈমন্তীর ওপর চোখ রাখতে বলবে–এ রকম কুৎসিত নোংরা সুরেশ্বর কখনও ছিল না, কখনও হবে না। তার ঈর্ষার বা সন্দেহের…
ঈর্ষা বা সন্দেহে কথাটা যেন মাথার মধ্যে ঝিলিকের মতন এল। অনেক সময় যেমন চোখ ফেরাতে গিয়ে বা অন্য কোনও দিকে তাকাতে গিয়ে সহসা রোদের কোনও ঝিলিক বা প্রতিফলিত আলোর তীর এসে চোখের মণিতে লেগে চোখটা কেমন হয়ে যায়, সেই রকম মনে এবং চিন্তার মধ্যে ঈর্ষা ও সন্দেহ কথাটা তীরের মতন এসে লাগল। হৈমন্তী কেমন অ-জ্ঞানে পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল, বেহুশ, কিছু দেখতে পেল না, কিছু ভাবতে পারল না, নিশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেল। তারপর হঠাৎ বুকে কষ্ট অনুভব করতেই চোখ তুলে পথ এবং গাছপালা দেখল, নিশ্বাস নিল। একটা গোরুর গাড়ি আসছে, অনেকটা দূরে লাঠা, শনশন বাতাস বইছে, শালের চারা-ঝোঁপের ওপর দিয়ে বুনো মুরগি ফরফর করে উড়ে গেল।
ঈর্ষা, সন্দেহ…! কার ওপর ঈর্ষা, কী বিষয়ে সন্দেহ?
মনে মনে অবনীর মুখ দেখতে পেল হৈমন্তী। ইদানীং অবনীর সঙ্গে তার মেলামেশা বেশ সহজ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। দেখাসাক্ষাৎ ঘটছে। হৈমন্তী স্টেশনে যায়, অবনীও আসে; তবে একেবারে হালে কাজেকর্মে অবনী তেমন আসতে পারছে না। হৈমন্তী আজও অবনীর কাছে যাচ্ছে। শুধু অবনীর কাছে নয়, তার কিছু কেনাকাটা করার আছে; রেডিয়োর ব্যাটারি, একটা ক্রিম, মাথার তেল, ওভালটিন– এই সব।
হৈমন্তী হাঁটতে লাগল। এখন তার কেমন অদ্ভুত লাগছিল। সুরেশ্বরের মধ্যে ঈর্ষা বা সন্দেহ বলে কিছু থাকতে পারে এ কথা ভাবা যায় না। কী কারণেই বা ঈর্ষা হবে? অবনীর সঙ্গে হৈমন্তীর মেলামেশায় তার কিছু আসে যায় না, যায় কি! সুরেশ্বর ন্যায়ত ও সঙ্গতভাবেই অবনীর ওপর ঈর্ষা বোধ করতে পারে না, হৈমন্তীর ওপর সন্দেহও তার থাকা উচিত নয়। বলতে কী, আজ হৈমন্তী ও সুরেশ্বরের মধ্যে যে সম্পর্ক তাতে হৈমন্তী অন্য কারও সঙ্গে কীভাবে মেলামেশা করছে, কী ধরনের ঘনিষ্ঠতা হচ্ছে ওদের, তাতে কী এল গেল তার! যদি ভালবাসার কথাও হয় হৈমন্তী অন্য কাউকে ভালবাসল কী বাসল না তা নিয়ে সুরেশ্বরের গায়ে জ্বালা ধরার কিছু নেই।
চিন্তাটা এবার যেন কৌতুকের মতন হয়ে উঠেছে। হৈমন্তী নিজের এই হাস্যকর চিন্তায় লঘু হয়ে হেসে ফেলতে গেল। অথচ হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না, কোথাও যেন একটা বাধা এল। কীসের বাধা?