ও! তবে থাক; তোমায় যেতে হবে না। হৈমন্তী আর অপেক্ষা করল না; তার হাতে তোয়ালে, কলঘরের দিকে চলে গেল।
মালিনী বেশ দ্বিধায় পড়ল। হেমদি একা একা যাবে, সেটা কি ভাল দেখাবে? দাদা হয়তো রাগ করবেন। হেমদি যে একলা কখনও স্টেশনে যায়নি তা নয়, সেবার গিয়েছিল। দাদা একটু অখুশি হয়েছিলেন। একগাদা বই, কিছু জিনিসপত্র নিয়ে হেমদি ফিরে এলে দাদার নজরে পড়েছিল। অত জিনিসপত্র হেমদি একলা বয়ে আনায় দাদা আড়ালে মালিনীকে বলেছিলেন, তুমি সঙ্গে গেলে পারতে।
সে তো পারতই মালিনী। কিন্তু সেদিন অনেকগুলো কাজ ছিল হাতে, হেমদিও হঠাৎ যাওয়া স্থির করে ফেলেছিল। আজও সেই রকম। দুপুরে শুয়ে শুয়ে হয়তো হঠাৎ মাথায় পোকা ঢুকেছে, স্টেশনে যাব, অমনি সঙ্গে সঙ্গে তৈরি। কিংবা পড়ার বই ফুরিয়ে গেছে, জিনিসপত্রও কিছু কেনাকাটা করতে হবে, স্টেশন যাচ্ছে। …তা যাক এখন কী করা যায়? চলে যাবে মালিনী? ছুটে এক দৌড়ে গিয়ে দাদাকে বলে আসবে? হাতের কাজগুলো আর কাউকে সেরে দিতে বলবে?
অত তাড়াতাড়ি সব হয় না। হাতের কাজ অবশ্য এমন কিছু নয় যার দু-একটা চটপট সেরে, বাকিটা পারবতিয়ার হাতে দিয়ে সে চলে যেতে না পারে। কিন্তু দাদা? দাদাকে না বলে সে যায় কী করে?
হৈমন্তী কলঘর থেকে ফিরল, চোখমুখ ভিজে, কপাল আর কানের কাছের এলোমেলো চুলগুলিতে জলবিন্দু, গলার তলায় সাবানের একটু ফেনা।
হৈমন্তী কাছে এলে মালিনী বলল, হেমদি, আপনি তৈরি হতে থাকুন, আমি একছুটে দাদাকে একবার বলে আসি।
হৈমন্তী যেতে যেতেই জবাব দিল, থাক।
মালিনীর পাশ দিয়ে চলে গেল হৈমন্তী। মালিনী এবার বলল, চা খেয়ে যাবেন না?
সময় নেই—
জল বসিয়ে দিচ্ছি, আপনার কাপড় বদলাতে বদলাতে হয়ে যাবে।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না, ঘরে ঢুকে গেল।
এ এক জ্বালা হল মালিনীর। হেমদি হয়তো রাগ করল। সত্যি, রাগ করার কথাই। হেমদি কী তার মতন, যে এখন লাঠা পর্যন্ত একা একা টংটং করে হাঁটবে, হাতে হয়তো একগাদা বই থাকবে, তারপর লাঠার মোড়ে গিয়ে হাঁ করে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা, দেহাতিগুলো আবার হেমদিকে চিনে গেছে, উঁকিঝুঁকি দেবে, খাতির দেখাবে, পানের দোকান থেকে ভাঙা টিনের চেয়ার এনে রাস্তার সামনে পেতে দেবে বসতে।
মালিনী ঘরে এসে তাড়াতাড়ি চায়ের জল বসিয়ে দিল স্টোভে। দিয়ে চোখমুখ ধুয়ে আসতে গেল।
.
হৈমন্তী প্রায় তৈরি হয়ে নিয়েছে। মালিনী চা নিয়ে এল।
অবনীর কাছ থেকে আনা খান ছয়েক বই চামড়ার কালো বড় ব্যাগটায় পুরে নিচ্ছে হৈমন্তী। মালিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল দুমুহূর্ত, তারপর বলল, আপনি চা টুকু খান হেমদি, আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
হৈমন্তী পিছন ফিরে মালিনীর দিকে তাকাল না, জবাবও দিল না।
মালিনী কী করবে বুঝতে পারল না; তার মনে হল হেমদি রাগ করেছে। ইতস্তত করে মালিনী আবার বলল, আপনার হতে হতে আমারও হয়ে যাবে। আপনি বরং ব্যাগটা আমায় দিয়ে এগুতে থাকুন আমি রাস্তায় আপনাকে ধরে নেব।
থাক, তোমায় যেতে হবে না, হৈমন্তী এবার জবাব দিল।
মালিনী চুপচাপ। তারপর আস্তে করে বলল, আপনি একলা যাবেন?
কেন, কী হয়েছে? হৈমন্তী দেওয়ালে টাঙানো আয়নার কাছে গিয়ে মুখ দেখে মাথার চুল সামান্য ঠিক করে নিল।
ফিরতে তো রাত হয়ে যাবে। ভয়ে ভয়ে মালিনী বলল।
সে ভাবনা আমার।
মালিনী বুঝতে পারল না সে এমন কী করেছে যার জন্যে হেমদি তার ওপর এত রেগে গেল। হেমদির আজ কদিন কেমন অদ্ভুত রাগ-রাগ ভাব হয়েছে।
হৈমন্তী তাড়াতাড়ি চা খেতে লাগল। চা খেতে খেতেই গরম কোটটা টেনে নিয়ে বিছানায় রাখল।
এবার সরলভাবে মালিনী বলল, হেমদি, আপনি একলা একলা স্টেশনে গেলে দাদা রাগ করবেন।
হৈমন্তী যেন থমকে গিয়ে মালিনীর মুখের দিকে তাকাল, চোখ লক্ষ করল। মুখের গাম্ভীর্য আরও ঘন হয়ে এল; চোখের মণি উজ্জ্বল হল।
মালিনী কিছু বুঝতে পারল না, তাকিয়ে থাকল সরলভাবেই।
হৈমন্তী বিরক্তভাবে বলল, তোমার দাদা কি আমার সঙ্গে সঙ্গে তোমায় ঘুরতে বলেছে?
কথাটার জটিল অর্থ মালিনী ধরতে পারল না, সেবার আপনি একলা গিয়েছিলেন, দাদা আমায় বললেন–আমি কেন সঙ্গে যাইনি।
সুরেশ্বর কি হৈমন্তীর আসা-যাওয়ার খবরদারি করতে চায়? হৈমন্তীর মুখ লাল হয়ে উঠল রাগে, চোখমুখে হলকা লাগল আঁচের। মালিনীর সামনে নিজেকে যথাসাধ্য সংযত করে হৈমন্তী বলল, তুমি যাও, কর্তামি কোরো না।
মালিনী কেমন বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত, তারপর অপরাধীর মতন মুখ নিচু করে চলে গেল।
অল্প একটু সময় হৈমন্তী কেমন নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, কিছু ভাবতে পারল না। চা আর খেল না। জানলা বন্ধ করে দিল, দরজার তালা খুঁজে নিল। গরম জামাটা হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে, ব্যাগ হাতে বাইরে এল। তালা দিল দরজায়। মালিনীই সাধারণত তার ঘরদোর বন্ধ করে, দরজায় তালা দেয়, চাবি রাখে। আজ হৈমন্তী নিজের হাতেই সব করল, মালিনী খানিকটা তফাতে তার ঘরের কাছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। তালার চাবিটা পর্যন্ত দিল না হৈমন্তী। সব দেখেশুনেও যেন হৈমন্তী কিছু দেখেনি, মালিনীকে উপেক্ষা করে সে মাঠে নেমে গেল, মাঠ দিয়ে অন্ধ আশ্রমের ফটকের দিকে চলে গেল, তারপর ওপারে জামতলার রাস্তায়।