মার এই অহঙ্কারের মূল্য বাবাও দেননি৷ এমন কী তিনি কোনওদিন অনুভবও করেননি, তাঁর অপ্রকৃতিস্থ স্ত্রী তাঁকে ভোগবাসনা নিবৃত্তির জন্যে যে অফুরন্ত স্বাধীনতা দিয়েছিল তার জন্যে তাঁর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। বাবা কখনও মার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন না। শুধু মা মারা যাবার পর বাবা একদিন মার ঘরে বসে অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন।
এই অহঙ্কার-বোধ সুরেশ্বরকেও বাল্যকাল থেকে অধিকার করে বসেছিল। চাপা বেদনার মতন চাপা এই অহঙ্কার তার ছিল। পরে বয়েস হলে সুরেশ্বরের মনে হয়েছে, এই অহঙ্কার তার জীবনেও আত্মতৃপ্তির কারণ, এবং এই বোধই তার অভিমান। বাবার উপপত্নী ও তার সন্তানকে যখন সুরেশ্বর সম্পত্তির অংশ হিসেবে অর্থাদি দেয় তখনও সুরেশ্বর এই অহঙ্কার ও অভিমান বোধ করেছিল। সে যে দিতে পারে, দিতে তার কষ্ট নেই–এই কথাটা যেন সে বোঝাতে চেয়েছিল। যেমন মা বাবাকে অন্য রমণীর হাতে তুলে দিয়ে নিজের অহঙ্কারে আত্মপরিতৃপ্তি লাভ করেছিল, সেই রকম সুরেশ্বর নিজের সঙ্গত দাবির খানিকটা অনায়াসে ছেড়ে দিয়ে অভিমানকে রক্ষা করেছিল ও আত্মতুষ্টি লাভ করেছিল।
হৈমন্তীর অসুস্থতার সময়ও কী সুরেশ্বর যা করেছিল তা অহঙ্কারবশে?
সুরেশ্বর আপাতত যে কোনও কারণেই হোক কথাটা আর ভাবতে চাইছিল না। সম্ভবত বিষয়টা আরও জটিল এবং জটিল বলেই নিঃসংশয়ে কিছু বলা যায় না,ভাবাও উচিত না। অনেক সময় কর্তব্য পালন করে মানুষ আত্মতৃপ্তি পায়, সাহায্য করেও সুখ বা আনন্দ পায়। সেভাবে দেখলে, সেই অদ্ভুত যুক্তি মানতে হয়, মানুষ এক ধরনের সুখান্বেষী যন্ত্র বই কিছু না, তার প্রত্যেকটি কাজই যান্ত্রিক। ঘড়ির কাঁটার মতন সে শুধু ঘুরতে পারে, দম যতক্ষণ আছে, যতক্ষণ কলকবজা না বিগড়োচ্ছ। আর এই কলকবজাও বাঁধা ধরা, মাপামাপি করে বসানো। এই ধরনের যুক্তিতে সুরেশ্বরের কোনও আস্থা কোনও কালেই নেই। শীতার্ত, গরিব, নিরাশ্রয় ভিক্ষুককে আশ্রয় দিলে, বা তাকে একটা টাকা সাহায্য করলে আত্মতৃপ্তি ঘটে, আর আত্মতৃপ্তি ঘটে বলেই আমার দয়া-বোধ জাগে এমন নির্মম যুক্তি স্বীকার করা যায় না। সেভাবে বিচার করলে মানুষের কিছু থাকে না, সবই একটা আত্মতৃপ্তির হেতু হয়ে দাঁড়ায়; দয়া, ধর্ম, প্রেম, করুণা, মমতাকী বা নয়। ..হেমকে বা হেমদের পরিবারকে সাহায্য করার পিছনে সুরেশ্বরের কিছু গোপন ক্রয়বিক্রয় ছিল–এমন তার মনে হয় না। তার মনে হয়েছিল সাহায্য করাটা তার কর্তব্য; তার মনে হয়েছিল, হেমকে সে ভালবাসে, তার মনে হয়েছিল তার কাছে হেমের জীবনের মূল্য আছে। এবং একথাও ঠিক, সাহায্য করে, ভালবেসে, হেমের জীবনের জন্যে মূল্য আরোপ করে সে সুখ পেয়েছিল। যদি কেউ মনে করে, সুরেশ্বরের এ-সবই অহঙ্কারবোধ থেকে এসেছে তবে হৈমন্তীর আজকের কথাটা সুরেশ্বর এখন আর খুঁটিয়ে না ভেবে হৈমন্তীর আজকের ব্যবহার থেকে যা বোঝা গেছে তার কথা ভাবতে লাগল।
হেম তার প্রতি সন্তুষ্ট নয়, আশ্রমের প্রতিও না। এই অসন্তোষ এবং বিরক্তিবশে সে বিরূপ হয়ে উঠেছে। সে ক্ষুব্ধ, অপ্রসন্ন। আজকাল সুরেশ্বরের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন একটা রেষারেষির মধ্যে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে যেন। অন্তত আজকের আচরণ থেকে মনে হয়, হেম যা করেছে তা সুরেশ্বরকে অবজ্ঞা করার জন্যে, তাকে আহত করার জন্যে। এই রেষারেষির কোনও দরকার ছিল না। কিন্তু হেম ক্রমশই কেমন তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছে, এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে সে সুরেশ্বর ও এই আশ্রমকে এড়িয়ে থেকে তার অবজ্ঞা বোঝাতে চাইছে।
হেম কেন অকারণে এই অশান্তি সৃষ্টি করছে সুরেশ্বর বুঝতে পারল না। ভাল না লাগলে সে চলে যেতে পারে, জোর করে তাকে কেউ ধরে রাখবে না।
.
১৭.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে মালিনীকে ডাকল হৈমন্তী।
শীতের গাঢ় দুপুরের নিবিড়তা এবার যেন কেটে যাবার সময় এসেছে, রোদ নিষ্প্রভ ও হলুদ হয়ে এল। মালিনীর ঘরের দিকে পশ্চিম হেলে বারান্দায় রোদ পড়ে আছে একটু।
মালিনীর সাড়াশব্দ নেই। হৈমন্তী আবার ডাকল।
উত্তরের বাতাসে আজ বেশ ধার। আজকাল দুপুর ফুরোবার আগে থেকেই উত্তর থেকে বাতাস আসতে শুরু করে। ঝাঁপটা দিয়ে বাতাস আসছে। ঝাঁক বেঁধে ফড়িং আর প্রজাপতি নেমেছে মাঠে; মাঠের রোদে, ঘাসের ডগায়, ফুলগাছের ঝোপেঝাড়ে ফড়িং, আর প্রজাপতি উড়ছিল। টিয়া ডাকছিল।
বার দুই ডাকার পর মালিনী বাইরে এল। শীতের দুপুরে ঘুমোচ্ছিল, চোখ ফুলে গেছে: ঘুম থেকে উঠে আসায় হাই তুলছিল বড় বড়।
হৈমন্তী বলল, স্টেশনে যাবে?
মালিনী প্রথমটায় যেন বুঝল না, পরে বুঝল। আপনি যাচ্ছেন?
যাবে তো তাড়াতাড়ি নাও। তিনটে প্রায় বাজে।
স্টেশনে যাবার কথা বললে মালিনী সব সময় পা তুলে থাকে। তবে যাবার আগে সুরেশ্বরকে জিজ্ঞেস করা তার অভ্যেস। অন্যদিন হেমদি আগেভাগেই বলে রাখে, মালিনীও অনুমতি নিয়ে রাখে সুরেশ্বরের, হাতের কাজকর্মও সেরে রাখে। আজ একেবারে হুট করে বলা, হাতেও সময় নেই, দাদা হয়তো এখন বিশ্রাম করছেন, কাজকর্মও কিছু সেরে রাখেনি সে। মালিনী দোনামোনা করল, সে যেতে চায় কিন্তু হ্যাঁ বলতে পারছে না।
মালিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে হৈমন্তী বলল, কী ভাবছ?
না, ভাবিনি মালিনী মাথা নাড়ল। দাদাকে যে কিছু বলিনি, হেমদি। কাজ সারাও হয়নি।