শীতের মধ্যে অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর নিজের ঘরের কাছে চলে এল।
হেম বড় অবুঝ হয়ে উঠেছে। সে তার কাজ এবং অধিকার নিয়ে আজ যা বলল তাতে সুরেশ্বর ক্ষুণ্ণ হয়েছে। সুরেশ্বর বাস্তবিকই নিজের কোনও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যায়নি। হাসপাতালের ব্যাপারে নিজের মতামত চাপানোর কথাও সে ভাবেনি। তবু হেম ধরে নিল, সুরেশ্বর তার অধিকার দেখাতে এসেছে। …আমার আশ্রম, আমার হাসপাতাল, আমার কথা মতন কাজ হবে–ঠিক এই ধরনের মনোভাব কি সুরেশ্বর কোথাও প্রকাশ করেছে? জ্ঞানত করেনি, অজ্ঞানত যদি করে থাকে সে জানে না। হেমকে সুরেশ্বর ডেকে পর্যন্ত পাঠায়নি, নিজে এসেছিল, কোনও কৈফিয়ত চায়নি, রূঢ় কথা বলেনি। তবু হেম তাকে অন্যরকম ভাবল।
কিন্তু…, সুরেশ্বর এখন কোথাও যেন অদ্ভুত এক পীড়ন বোধ করল। অনুভব করল, হৈমন্তীর শেষ কথাটা তার অহঙ্কারে লেগেছে। এর আগে কখনও কেউ সুরেশ্বরকে এভাবে বলেনি, বা বোঝবার অবকাশ দেয়নি যে, সুরেশ্বর এই আশ্রমকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে। হেম ঘুরিয়ে সেকথা বোঝাবার চেষ্টা করেছে। বলতে চেয়েছে, তার অধিকারের সীমা সুরেশ্বর লঙ্ঘন করতে গিয়েছিল।
আশ্চর্য! আজ চার বছর তো সুরেশ্বরের একথা মনে হয়নি, আশ্রমের ওপর সে কর্তৃত্ব করার আনন্দ পেতে চায়। বা এমনও তার মনে হয়নি, এই আশ্রমের সঙ্গে তার অদ্ভুত এক অহঙ্কার জড়িয়ে আছে, এবং নিজের অধিকার সে যত্রতত্র প্রয়োগ করার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে। এই আশ্রম আমার, আমি এর মালিক, আমায় তোমাদের মান্য করা উচিত–এ-ধরনের নোংরা, বিশ্রী চিন্তা ও আত্মসন্তুষ্টির ভাব সুরেশ্বরের কোনওদিন কি হয়েছে।
মাথা নাড়ল সুরেশ্বর, না তার মনে এমন কোনও অহং-বোধ নেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে কোথায় যেন কাতর হল এবং ভাবল, যদি এই বোধ আমার না থাকে তবে হেমের কথায় বিচলিত হলাম কেন? কেন আমার তখন মনে হয়েছিল, কী স্পর্ধা হেমের, কী স্পর্ধা! যদিও আমি তখন স্তম্ভিত নির্বাক ছিলাম, কিন্তু আমার মনের মধ্যে কে যেন হঠাৎ বিশ্রীভাবে আঁচড় বসিয়ে দিয়েছিল, জ্বালা করছিল; কেমন এক তপ্ত রোষ আমার চোখে ও মুখে এসে পড়েছিল। আমি সংযত থাকার চেষ্টা করেছি, হয়তো পারিনি, হেম আমার চোখ মুখের ভাব দেখতে পেয়েছে।
কেমন এমন হয়, কেন? সুরেশ্বর যেন গ্লানি অনুভব করছিল। মাথা মুখ নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠল।
নিজের সমর্থনে তার যুক্তি নেই এমন নয়। হেমের সমস্ত ব্যবহারের মধ্যে অগ্রাহ্যের ভাব ছিল, নির্দয়তা ছিল; অবিবেচনা ও অন্যায়ের জন্যে হেমের ওপর তার বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। সুরেশ্বর এই ধরনের রূঢ়তা প্রত্যাশা করেনি। তবু, সুরেশ্বরের মনে হল-সে হেমের কাছে তার কর্তৃত্ব প্রকাশ করে ফেলেছিল। সুরেশ্বর বলেছিল: হাসপাতালের কথা আমায় জানাবে না…? বাকিটা বলেনি, কিন্তু বোঝাই যায় সুরেশ্বর বলতে চেয়েছিল, আশ্রমের কোথায় কী হয়, কী হচ্ছে, কী হবে–সবই তাকে জানানো দরকার; তাকে না জানিয়ে তার মতামত না নিয়ে কিছু হতে পারে না। হেম সুরেশ্বরের এই প্রভুত্ব অথবা কর্তৃত্বের রূপটি ধরতে পেরেছে, পেরেছে বলেই সমান উদ্ধত হয়ে তার অধিকারের কথা তুলেছে।
ঘরে এসে বসল সুরেশ্বর। লণ্ঠনের আলো তেমন উজ্জ্বল নয়। ঘর প্রায় আবছা অন্ধকার হয়ে আছে, কনকন করছে ঠাণ্ডা, ভরতু একটা বই অন্য জানলা বন্ধ করেনি ঘরের, জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
কেমন যেন অপরাধীর মতন বসে থাকল সুরেশ্বর; তার গ্লানি ও অনুশোচনা হচ্ছিল। এখন বেশ স্পষ্টই সে বুঝতে পারছিল, হেমের কাছে যতই সে বিনীত নম্র সরল হয়ে উপস্থিত হয়ে থাকুক তার মধ্যে কোথাও এই বিশ্রী অহঙ্কার ছিল। আশ্রমের ব্যাপারে তার কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ণ করা তার সহ্য হয়নি, ভাল লাগেনি। সে অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হয়েছিল।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে, সুরেশ্বর তার বিচলিত ভাব দমন করল। তার মনে হল, হেম যেমন খানিকটা বাড়াবাড়ি করেছে, সেও সেই রকম খানিকটা বাড়াবাড়ি করছে। এতটা কাতর হবার বা গ্লানি বোধ করার কিছু নেই। আশ্রমের ভালমন্দ, রোগীদের সুবিধে অসুবিধে দেখা তার কর্তব্য। হেম যদি অন্যায় করে, যদি তার কাজেকর্মে রোগীদের বা হাসপাতালের ক্ষতি হয় সুরেশ্বরের সে-বিষয়ে কথা বলার অধিকার আছে। যুগলবাবু কি শিবনন্দনজিও একথা বলতে পারতেন। যুগলবাবুও রোগী তাড়ানোর ব্যাপারে সন্তুষ্ট নন। শিবনন্দনজি–যাঁর সঙ্গে হাসপাতালের কোনও সম্পর্ক নেই, তিনিও কথাটা শুনে বলেছিলেন, কাজটা ভাল হয়নি।
মনের ক্ষুব্ধ ও কাতর ভাবটা কমে এলেও সুরেশ্বর কোথাও যেন একটা কাঁটা ফুটে আছে অনুভব করছিল। এই কাঁটা কী, ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। হতে পারে হৈমন্তীর কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত আঘাত, হতে পারে নিজের কোনও দুর্বলতা আজ তার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। অন্য কিছুও হতে পারে।
জীবনের যে সমস্ত মোটা তার সুরেশ্বর মোটামুটি একটা সঙ্গতির মধ্যে বেঁধে ফেলেছিল বা সে-চেষ্টা করে আসছিল তার মধ্যে কোনও একটা তার সুরেশ্বরের বাঁধাঘাট ছেড়ে হঠাৎ যেন ছিঁড়ে লাফিয়ে উঠল আজ। সেটা কী? অহঙ্কার?
অহঙ্কার সুরেশ্বরের মধ্যে বরাবরই ছিল, বাল্যকাল থেকেই। সম্ভবত মার চরিত্র থেকে এই অহঙ্কার-বোধ সে পেয়েছিল। বাবা যে ধরনের অহঙ্কারী ছিলেন তা সাধারণ অহঙ্কার, বিত্ত ও বংশমর্যাদার অহঙ্কার; কিন্তু মার অহঙ্কার ছিল অন্য রকম। রূপের জন্যে মার কোনও অহঙ্কার ছিল না, কেননা অসামান্য রূপ সত্ত্বেও মা সেই রূপের মধ্যে বাবাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। হয়তো সেজন্যে রূপের ব্যাপারে মা হতাশ হয়ে পড়েছিল। মার অহঙ্কার ছিল অন্য জায়গায়, এবং সেটা অদ্ভুত। মা হঠাৎ এমন কিছু করে বসত যা সচরাচর লোকে করে না। একথা ঠিক, মার স্বভাব খেয়ালি ছিল এবং মা ঠিক প্রকৃতিস্থ থাকত না সব সময়; তবু মা সংসারের মধ্যে এমন কোনও কোনও আশ্চর্য কাণ্ড করে বসত যা কল্পনা করা যায় না। নিজের জীবনেও মা এরকম করেছে। বিনুমাসি যখন খুব একটা খারাপ অসুখে পড়ল মা তাকে নিজের ঘরে এনে তুলল, নিজের বিছানায়। মাসখানেক ধরে বিনুমাসির রোগের সঙ্গে মার যেন দুবেলা লড়াই চলল। বিনুমাসি সেরে উঠলে মা নিজের ভারী ভারী দুটো গহনা তার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এবার ধর্মকর্ম করগে যা, পরের বাড়িতে অনেক দিন কাটালি। তুই যা আমি তোকে মাসে মাসে বিশ পঁচিশটা টাকা দেব। কারও বাড়িতে ঝিগিরি করবি না, হারামজাদি; আমার দিব্যি রইল। যা। .বিনুমাসি যাবে না, মা তাকে জোর করে যাওয়াল। লোকে বলেছিল: একটা ঝিয়ের জন্যে এত আদিখ্যেতা দেখানো কেন? …বিনুমাসি যদিও ঠিক ঝি ছিল না, তবু মার নিজের দাসী তো বটেই। বিনুমাসিকে পুরী পাঠিয়ে মা প্রায়ই বলত: বিনু পেপাড়ারমুখী যতদিন বাঁচবে ততদিন আমার কথা ভাববে, বুঝলি। এই রকম অনেক করেছে মা, কাউকে মেয়ের বিয়েতে নিজের গয়না দিয়ে দিয়েছে, কাউকে আশ্রয় দিয়েছে বারবাড়িতে বরাবরের মতন, কাউকে আবার সামান্য কারণে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলতে কী, নিজের জীবনে মা এই অদ্ভুত অহঙ্কারের জন্যে স্বামীকে পর্যন্ত অন্য রমণীর সঙ্গে বসবাস করতে ছেড়ে দিয়েছে। …এই অহঙ্কারের মধ্যে মার এক আশ্চর্য আত্মতৃপ্তি ছিল। মা ভাবত, এইসব করে মার মর্যাদা বাড়বে, লোকে মার গুণগান গাইবে। এই রকম গুণগান কিন্তু বিনুমাসি ছাড়া আর কেউ গায়নি। বিনুমাসি এখনও বেঁচে আছে, বুড়ো হয়ে গেছে, পুরীতেই থাকে, সুরেশ্বরকে অন্তত বছরে দু-একবার চিঠিও লেখে। বিজয়ার পর বিনুমাসির চিঠি আসে; বাবা সুরেশ, আমার বিজয়াদশমীর আশীর্বাদ নেবে…….বিনুমাসি এখানে আসতে চায়, সুরেশ্বর আনে না। এতকাল যার পুরীতে কাটল, তাকে এখানে এনে কষ্ট দেওয়া।