কীভাবে ধরব?
তর্কের কথা নয়, হেম। আমি ওদের অসুবিধের কথা তোমায় জানাচ্ছি শুধু। তুমি যদি নিয়ম ঠিক করে দেবার আগে আমায় একবার জানাতে…
না জানিয়ে অন্যায় হয়েছে, হৈমন্তী বিরক্ত গলায় বলল, কিন্তু আমার পক্ষে হাসপাতালটাকে মেঠাইমণ্ডার দোকান করে রাখা সম্ভব না।
সুরেশ্বরের কপালে কয়েকটা রেখা ফুটে উঠল। তুমি কি আমাদের হাসপাতালটাকে শহরের হাসপাতাল করে তুলতে চাও?
আমি কিছুই চাই না। সব জিনিসের একটা নিয়ম থাকা দরকার। আমি তোমার রোগীদের চাকর নই যে যখন তারা ডাকবে আমায় ছুটতে হবে। আমার স্নান, খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রামের একটা সময় রাখা দরকার। হৈমন্তী উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল।
সুরেশ্বর এবার কেমন ক্ষুব্ধ হল। বলল, কত দূর থেকে সেদিন দুজন এসেছিল তুমি তাদের ফিরিয়ে দিয়েছ। নিজের সামান্য অসুবিধে করেও কী তুমি তাদের দেখতে পারতে না?
হৈমন্তীর আর সহ্য হল না। প্রচণ্ড বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঙ্গে বলল, না, পারতাম না। শীতের বেলা, আমি দেড়টা দুটোর সময় স্নান করে ভাত খেতে বসি। তার পরও তোমার রোগীরা যদি আসে, আমার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। তোমার রোগীরাই শুধু মানুষ নয়, আমিও মানুষ।
সুরেশ্বর কেমন যেন বিস্মিত হল। এমন রূঢ়, নির্মম, নির্দয় প্রত্যুত্তর যেন সে আশা করেনি। বলল, হেম, আমি কী তোমায় তোমার যা অসাধ্য তা করতে বলেছি? আমি শুধু বলতে এসেছিলাম, তোমার অসুবিধের কথা আমায় যদি জানাতে…
তোমায় জানাবার হলে জানাতাম।
সুরেশ্বর অবাক হল। হাসপাতালের ব্যাপারে আমায় তুমি জানাবে না…
না। হাসপাতালের রোগীদের আমি কখন দেখি, কী করে দেখি, কেন দেখি না–এসব তোমাকে জানানোর কোনও দরকার আমি মনে করি না। আমি ডাক্তার, আমার অধিকার যদি তুমি না মানো, তবে রোগী দেখা বন্ধ করে দেব।
সুরেশ্বর স্তব্ধ, নির্বাক বয়ে বসে থাকল।
৪. নীরবে কিছু সময়
১৬.
নীরবে কিছু সময় বসে থেকে সুরেশ্বর উঠল। তার মুখে না প্রসন্নতা, না অসন্তোষ বা বিরক্তি। স্মিত সরল হাসিও ছিল না; কেমন এক গাম্ভীর্য ঘন হয়ে উঠেছিল মুখে। এই গাম্ভীর্যে কোনও মানুষের ক্রোধ বা বিতৃষ্ণাও প্রকাশ করে না; মনে হয় অন্যমনস্কতাবশত এবং বেদনাজাত এক মালিন্য সৃষ্টি হয়েছে।
হৈমন্তীর ঘর থেকে শান্তভাবেই বিদায় নিয়ে সুরেশ্বর বাইরে চলে এল।
বাইরে শীত বেড়েছে। উত্তরের বাতাস এখনও তেমন করে বইতে শুরু করেনি। তবু আজ বাতাসে ধার ছিল, থেমে থেমে উত্তরের দমকা আসছিল। অগ্রহায়ণের শেষ, চারপাশে হিমের ধূসরতা জমছে, আকাশের তারাগুলি তেমন করে যেন জ্বলছে না। সুরেশ্বর ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল, যেন শীতের মধ্যে একা একা পায়চারি করছে।
হৈমন্তীর আজকের ব্যবহারে সে দুঃখিত, হয়তো ক্ষুব্ধ। তবু সুরেশ্বর হৈমন্তীর স্বপক্ষে চিন্তা করছিল। অপরের প্রতি বিরক্ত হওয়ার মধ্যে কৃতিত্ব বা কষ্ট কিছুই নেই যেন এই ধরনের মনোভাবের বশবর্তী হয়ে সে হৈমন্তীর প্রতি সহৃদয় হচ্ছিল এবং ভেবে দেখার চেষ্টা করছিল হৈমন্তী এতটা রূঢ় হল কেন।
হেম যে অসঙ্গত কিছু বলেছে তা হয়তো নয়, সুরেশ্বর ভাবছিল, হাসপাতাল আর মেঠাইমণ্ডার দোকান কখনও এক হতে পারে না। কলকাতার হাসপাতালে হেমের যা শিক্ষা তাতে সে নিয়মের বাইরে যেতে চায় না, হয়তো পারে না। হাসপাতালের বাঁধা নিয়ম সে রাখতে চায়। এতে দোষের কিছু নেই, বা তার পক্ষে অন্যায় কিছু হয়নি। তা ছাড়া, সুরেশ্বর নিজেও মনে করে, হেমের শরীর স্বাস্থ্যের ওপর লক্ষ রাখা উচিত, অনিয়ম ও অত্যধিক পরিশ্রম তার পক্ষে ক্ষতিকর।
কিন্তু, সুরেশ্বর ভাবল, হেম সহৃদয়তার সঙ্গে বিষয়টা বিবেচনা করতে কেন রাজি হল না? এই অনিচ্ছুক আচরণ তার কেন? যদি সে অত্যধিক পরিশ্রমের কথা তোলে তবে তার বিবেচনা করা উচিত ছিল, এখানে তা নিত্য হয় না, প্রত্যহ একরাশ রোগী এখানে চোখ দেখাতে আসছে না। সকালের দিকে দু-চারজন, বেলায় আরও কয়েকজন। মোটামুটি হিসেব নিলে হয়তো দেখা যাবে, সারাদিনে সাধারণভাবে আট দশজনের বেশি রোগী আসে না। হাটের দিন কিছু বাড়ে। তেমনি আবার মাঝে মাঝে সারাদিনে একটি দুটি রোগীর বেশিও যে হয় না।
হেমের এসব কথা ভাবা উচিত ছিল; ভাবতে পারত, কোনও কোনওদিন যেমন তার অত্যধিক পরিশ্রম হয়, কোনও কোনওদিন আবার তেমন তার হাতে প্রচুর সময় থাকে, বিশ্রাম পায়। তা ছাড়া একথা ঠিকই, এটা কোনও শহরগঞ্জ নয়, এখানে চোখ দেখাতে আসব বললেই আসা যায় না। আসা-যাওয়ার এই অসুবিধে তার বিবেচনা করা উচিত ছিল। ইচ্ছে থাকলেও অনেকে যে উপায়হীন হয়ে দেরিতে আসে হেম কী তা বোঝে না? না কী তা বিবেচনা করা তার দায় নয়?
সুরেশ্বর মনে করে না, বিষয়টা বা সমস্যাটা গুরুতর কিছু ছিল। সামান্য ব্যাপার, হয়তো তুচ্ছ ব্যাপার। হেম হাসপাতালের নিয়ম রাখতে চাইছে, রাখুক, কিন্তু তার বাঁধাধরা সময়ের সামান্য এদিক-ওদিক করেই তা করা যেত। সুরেশ্বর ভেবেছিল, হেমকে বলবে: তুমি বরং সকালের দিকটা আরও একটু আগে হাসপাতাল থেকে চলে এসে, স্নান খাওয়া-দাওয়া বিশ্রাম সেরে দুপুরে আবার একবার যেয়ো, বিকেল পর্যন্ত থেকো।
সুরেশ্বরের ধারণা, মোটামুটি এই নিয়মটাতে কারও অসুবিধে হবার কারণ নেই। যেসব রোগীর আসতে বেশ বেলা বয়ে যায়, তারা, আর যারা দুপুরের দিকে আসে তাদের হেম দুপুর-বিকেলে দেখতে পারে। হাটের দিন ছুটকো এক-আধজন অসময়ে এসে পড়লেও হেম তাদের ব্যবস্থা করে নিতে পারবে।