সুরেশ্বর বলল, এই গানটা আমার মারও খুব পছন্দ ছিল। …তবু মার অহঙ্কার কোনওদিন ঘঘাচেনি।
হৈমন্তী গায়ের শাল আরও একটু ঘন করে নিল।
সুরেশ্বর হৈমন্তীর ঘর দেখতে লাগল। ইদানীং আসা হয়নি ঘরে। বিছানার ওপর মোটা কভার, ছোট টেবিলে লেসের কাজকরা ঢাকনা, নতুন বাতি, জানলায় পরদা, একপাশে আলনা, বইপত্র সাজানো রয়েছে অন্য পাশে, কিছু বা একধারে পড়ে আছে।
দেখতে দেখতে সুরেশ্বর বলল, তোমার এই ঘরটায় কুলোচ্ছে না, না হেম?
হৈমন্তী প্রথমে কোনও জবাব দিল না; পরে বলল, হয়ে যাচ্ছে.. বলে কাশল। তার কাশির শব্দ কানে লাগে।
অসুবিধে হচ্ছে। হচ্ছে না?
তেমন কিছু না।
হৈমন্তীর চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সুরেশ্বর এবার বলল, তোমার শরীর খারাপ! গলা ভার ভার লাগছে।
নতুন শীত; ঠাণ্ডা লেগেছিল।
জ্বর হয়েছিল?
অল্প; ছেড়ে গেছে। হৈমন্তীর বলার ধরন দেখে মনে হচ্ছিল সে খুব নির্লিপ্ত, নিরুত্তাপ।
হৈমন্তীর চোখ মুখ লক্ষ করতে করতে সুরেশ্বর বলল, তোমার মুখটাও এখনও ফুলে রয়েছে। …ওভাবে জড়সড় হয়ে আছ কেন? শীত করছে?
হৈমন্তীর শীত করছিল। পায়ের পাতা দুটো কনকনে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়ে গা সিরসির করছে।
ওষুধপত্র কিছু খেয়েছ? সুরেশ্বর জিজ্ঞেস করল।
মাথা নোয়াল হৈমন্তী; খেয়েছে। তার শরীর অসুস্থ এটা যেন সুরেশ্বরের অনেক দেরিতে চোখে পড়েছে। মনে মনে হৈমন্তী বিরক্তি বোধ করল কেমন।
বিছানায় ছিলে, বিছানাতেই গিয়ে বোসো না। সুরেশ্বর বলল।
থাক।
তোমার শরীর খারাপ আমায় তত কেউ বলেনি।
বলার মতন কিছু না।
সুরেশ্বর যেন অন্যমনস্ক হল সামান্য। পরে বলল, এখানকার শীত সওয়া নেই তোমার; গোড়ায় ঠাণ্ডা-ফাণ্ডা লাগবে, সইয়ে নিতে হবে ধীরে ধীরে।
এমন সময় মালিনী এল। দুকাপ চা নিয়ে এসেছে। এটা তার নিজের বুদ্ধিতে ঠিক নয়, খানিকটা আগে হৈমন্তী তাকে চায়ের কথা বলেছিল, সুরেশ্বর আসার আগেই। সাধারণত এসময় একবার ওরা চা খায়। তা ছাড়া হৈমন্তীর গলা অল্প ব্যথা ব্যথা করছিল, মাথাও সামান্য ধরে আছে।
সুরেশ্বর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হেসে মালিনীকে বলল, খাতির নাকি?
মালিনী সঙ্কুচিত হল। বলল, হেমদি আগেই চা খেতে চেয়েছিলেন।
ও! …তা রোজ বুঝি গানবাজনা শোনা হচ্ছে?
মালিনী নিচু মুখে সামান্য মাথা হেলাল।
হেমের শরীর খারাপ আমায় বলোনি তো?
মালিনী চুপ। হেমদি সম্পর্কে দু-একটা কথা আগে সে সুরেশ্বরকে বলত। হেমদি জানতে পেরে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিল। হেমদির সর্দিজ্বরের কথাটা অবশ্য সে একবার ভেবেছিল সুরেশ্বরকে বলবে, তারপর আর বলা হয়ে ওঠেনি, জ্বর ছেড়ে গিয়েছিল বলেই বোধ হয়।
হৈমন্তীর হাতে চায়ের কাপ দিয়ে মালিনী চলে গেল আস্তে আস্তে।
চা খেতে খেতে সুরেশ্বর আবার হৈমন্তীকে বিছানায় গিয়ে বসতে বলল। হৈমন্তী উঠল না, এক সময়ে, দিনের পর দিন সুরেশ্বরের চোখের সামনে সে বিছানায় শুয়ে বসে থেকেছে, সুরেশ্বর তার মাথার কাছে কখনও, কখনও বালিশের পাশে বিছানায় বসে থেকেছে। আজ হৈমন্তীর সে বয়েস নেই, সেই অবস্থাও না।
সুরেশ্বর এবার কথাটা তুলল, হেম, তোমার সঙ্গে একটা কথা আলোচনা করতে এলাম। কিন্তু তুমি ওভাবে বসে থাকলে বলি কী করে! …তোমায় ওই কম্বলটা এনে দেব?
সমস্ত ব্যাপারে সুরেশ্বরের এই নম্র, মধুর, শিষ্ট কথাবার্তা ও আচরণ একসময়ে হৈমন্তীর পছন্দ হত। এখন হয় না। এখন মনে হয় এ এক ধরনের কৃত্রিমতা, মানুষকে মোহিত করার, বশ করার কৌশল। হৈমন্তী সন্দিগ্ধ হল। হঠাৎ সুরেশ্বরের এখানে আসা, এসে খুশি মনে গান শোনা, গান শুনে নিজেও কৌতুক করে একটু গান গাওয়া, তারপর ক্রমে ক্রমে অবস্থাটা সইয়ে নিয়ে বলা–হেম তোমার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে এলাম–এর অর্থটা কী? কীসের আলোচনা?
হৈমন্তী নিতান্ত বাধ্য হয়ে বিছানার ধারে গিয়ে বসল, বসে কোলের ওপর দিয়ে কম্বলটা পায়ে চাপা দিল।
সুরেশ্বর বলল, শুনলাম তুমি হাসপাতালে চোখ দেখানোর একটা বাঁধাবাঁধি সময় করে দিয়েছ?
হৈমন্তী তাকাল, স্থির চোখ রেখে সুরেশ্বরের মুখভাব দেখল। তা হলে এই? হাসপাতালের ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে এসেছে? …জানতাম তুমি আসবে, মনে মনে ভাবল হৈমন্তী, কৈফিয়ত চাইতে আসবে।
হ্যাঁ, সময় বেঁধে দিয়েছি, হৈমন্তী বলল।
সুরেশ্বর শান্তভাবেই বলল, তোমার যে খুব অসুবিধে হচ্ছিলতা বুঝতেই পারছি। কিন্তু, আমি বলছিলাম, ওদের কথা ভেবে অন্য কিছু করা যায় না? সুরেশ্বর এমনভাবে বলল যেন মতামত চাইছে। কিন্তু হৈমন্তী জানে মতামত নিতে সুরেশ্বর আসেনি, তার মতামত ব্যক্ত করতে এসেছে।
না, আর কিছু করা যায় না, হৈমন্তী শক্তভাবে বলল। মনে মনে যেন সে ঠিক করে নিয়েছে সে যা স্থির করেছে তার জন্যে শেষ পর্যন্ত শক্ত থাকবে।
সুরেশ্বর জোর গলায় কিছু বলল না, শান্ত গলায়, হৈমন্তীকে যেন বোঝাচ্ছে, নরম গলায়, প্রায় অনুরোধ করার মতন বলল, আমি জানি হেম, ওদের সময়জ্ঞানটা কম। কিন্তু তুমি তো জানোই কীভাবে সব আসে, কত দূর দূর থেকে। নানা,ঝঞ্জাট করে আসা, গাড়ি-টাড়ি পায় না ঠিক মতন।
হৈমন্তী বিরক্ত হল, কী বলতে চায় সুরেশ্বর? সারাটা দিন ওই রোগীদের নিয়ে তাকে থাকতে হবে নাকি? হৈমন্তী বলল, হাসপাতালের একটা নিয়ম থাকে।
থাকে, তবে সেসব হল শহরের হাসপাতাল। এটাকে তুমি সেভাবে ধরছ কেন?