সুরেশ্বর কথাটা বলার জন্যে হৈমন্তীকে ডেকে পাঠাতে পারত। কিন্তু সুরেশ্বরের যে ধরনের স্বভাব তাতে এধরনের কথাবার্তা বলার জন্যে হৈমন্তীকে ডেকে পাঠানো তার উচিত মনে হল না। তা ছাড়া, হৈমন্তীর ঘরের দিকে সে বড় একটা যায়নি কখনও। মাঝে মাঝে তারও যাওয়া উচিত।
সেদিন সন্ধেবেলা সুরেশ্বর হৈমন্তীর ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল।
হৈমন্তীর ঘরের দরজায় পরদা ঝুলছে, আলো জ্বলছে ভেতরে, রেডিয়োতে গান হচ্ছিল, মৃদু সুরে পুরুষালি গলায় কেউ গান গাইছে। কৃষ্ণপক্ষ, অগ্রহায়ণের শেয, বাইরে বেশ শীত।
সুরেশ্বর সামান্য সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গানটি শুনছিল। এই গান তার বহুশ্রুত, কথাগুলি, এখনও মনে আছে, সুরও হয়তো ভুলে যায়নি সুরেশ্বর। শুনতে বড় ভাল লাগছিল সুরেশ্বরের।
গান শেষ হলে সুরেশ্বর ডাকল, হেম।
ঘরের মধ্যে মালিনী ছিল, সুরেশ্বরের গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি দরজায় এসে পরদা সরাল। মালিনী যেন অবাক, সামান্য অপ্রস্তুত। সুরেশ্বরকে ভেতরে আসতে বলতে পারল না মালিনী, শুধু পরদাটা আরও তুলে ধরল।
সুরেশ্বর ঘরে ঢুকল।
হৈমন্তী বিছানার ওপর উঠে বসেছে, পায়ের দিকে একটা হালকা কম্বল ছিল, পাট ভাঙা; বোঝাই যায় পায়ের ওপর টেনে নিয়ে শুয়ে বা বসে ছিল।
বিছানা থেকে নেমে পড়ল হৈমন্তী। মালিনী বিব্রতভাবে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল।
জানলার দিকে চেয়ারের কাছে এগিয়ে যেতে যেতে সুরেশ্বর বলল, বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গানের শেষটুকু শুনছিলাম।
হৈমন্তীর বেশবাসে সামান্য অবিন্যস্তভাব ছিল; গায়ের আঁচলটা ঢিলেঢালা, তার ওপর ছোট হালকা শাল জড়ানো। কোমরের কাছে আঁচলের কাপড় অনেকটা ঝুলে আছে, কুঁচি দিয়ে শাড়ি না পরার জন্যে সামনে কোনও কোঁচ ছিল না। একেবারে সাধারণভাবে ঘরোয়া করে শাড়ি পরা। মাথায় উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। হৈমন্তীর চোখ মুখ, মাথার চুল শুকনো ও লালচে দেখাচ্ছিল।
নিজের অবিন্যস্ত ভাবটা শুধরে নিয়ে হৈমন্তী রেডিয়ো বন্ধ করে দিতে গেল। সুরেশ্বর বাধা দিল, বলল, থাক না; গানটা শুনি।
হৈমন্তী রেডিয়োর সামনে দাঁড়িয়ে, সুরেশ্বর জানলার কাছে চেয়ারটিতে বসেছে। বসে অল্প অস্বস্তিবোধ করে হাত বাড়িয়ে জানলার বন্ধ পাট খানিকটা খুলে দিল। বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস ও শীত এল দমকা।
রেডিয়োতে গান হচ্ছিল; আমার মাঝে তোমার লীলা হবে..
সুরেশ্বর এভাবে আসবে, আচমকা, হৈমন্তী ভাবেনি। খুব কম, আঙুলে গুণেই বলা যায় হয়ত, সুরেশ্বর কদিন তার ঘরের বারান্দায় বা ঘরে পা দিয়েছে। এভাবে হুট করে এসে পড়ে হৈমন্তীকে যে খানিকটা বিব্রত করেছে সন্দেহ নেই। হৈমন্তীর শরীর ভাল নেই, বিছানায় পায়ের ওপর কম্বল দিয়ে শুয়ে ছিল, বইও পড়ছিল না আজ, মালিনী বসে ছিল, তার সঙ্গে গল্প করছিল।
হঠাৎ সুরেশ্বর এখানে কেন? কতক্ষণ বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে? এত মন দিয়ে গান শোনারই বা কী হল তার? …হৈমন্তী সুরেশ্বরকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করল। সুরেশ্বর একমনে গান শুনছে। শীত এমন কিছু কমনয়, তবুসুরেশ্বরের গায়ে হাতকাটা ছোট একটা ফতুয়া ধরনের গরম জামা ছাড়া পশমের কিছু নেই। পায়ের চটিটাও দরজার কাছে খুলে এসে খালি পায়ে বসে আছে।
হৈমন্তী আরও কয়েক মূহুর্ত রেডিয়োর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পাশের টুলটার ওপর বসল, মালিনী সেখানে নিত্য বসে। তার ঠাণ্ডা লাগছিল, বিছানা ছেড়ে নীচে নেমে আসায় পায়ের পাতা কনকন করছিল।
গান শেষ হল। …কী একটা অন্য জিনিস শুরু হতেই রেডিয়োটা বন্ধ করে দিল হৈমন্তী।
সুরেশ্বর যেন খুবই পরিতৃপ্ত হয়েছে, মুখ জুড়ে স্মিত হাসি, গানের থেকেই একটা কলি আবৃত্তি করল; আনন্দময় তোমার এ সংসার, আমার কিছু আর বাকি না রবে।
হৈমন্তী সুরেশ্বরের মুখের দিকে তাকাল, চোখ লক্ষ করল।
সুরেশ্বর বলল, এ একটা ভাল ব্যবস্থা করেছ। মাঝে মাঝে তোমার এখানে এসে গান শুনে যাব।
একসময়ে সুরেশ্বরের সঙ্গীতপ্রীতি ছিল। নিজেও সে একটু আধটু চর্চা যে না করেছে এমন নয়। হৈমন্তীর এসব অজানা ছিল না। কিন্তু এখনও যে সুরেশ্বরের সঙ্গীতপ্রীতি আছে হৈমন্তীর তা জানা ছিল না। মালিনীর কাছে অবশ্য শুনেছে, সুরেশ্বরকে নাকি আপনমনে অনুচ্চ কণ্ঠে গান গাইতে কখনও কখনও শোনা যায়; তেমন ভাগ্য, সে গান শোনার ভাগ্য, হৈমন্তীর এখানে এসে পর্যন্ত যদিও হয়নি৷ হৈমন্তী মনে মনে কেমন উপহাস বোধ করল; অন্ধ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সুরেশ-মহারাজ (বিজলীবাবু বেশ বলেন, হৈমন্তীর হাসি পায়) সাধারণ গানের ভক্ত এ যেন কেমন কথা!
সুরেশ্বর এবার বলল, বাইরে দাঁড়িয়ে আগের গানটা শোনার সময় আমার মনে হল, এখনও যেন সুরটা মোটামুটি মনে আছে। .. বলে সুরেশ্বর দু মুহূর্ত থেমে যেন অত্যন্ত সারল্যে এবং খুশিতে মৃদু সুরে গাইল; সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে। গেয়ে থেমে গেল।
হৈমন্তী অতিমাত্রায় বিস্মিত হল। অপলকে তাকিয়ে থাকল মানুষটির দিকে। গলা যেমনই হোক, সুরের ভুলচুক যাই ঘটুক তবু ওই মানুষ এখনও গান গাইতে পারল। লোকমুখে শুনলে বিশ্বাস হত না, কানে শুনেও যেন হৈমন্তীর বিশ্বাস হচ্ছিল না। সুরেশ্বর এক সময় এসব গান যে গাইত, হৈমন্তী জানে।
স্মৃতির মধ্যে ক্ষণিকের জন্যে সুরেশ্বরের সেই পুরনো চেহারাটি ফুটে উঠে আবার মিলিয়ে গেল।