তা কিন্তু নয়। হৈমন্তী বরাবর জেদ ধরে কিছু করেনি। আজ সাত আট কী তারও বেশি–এতগুলো বছর জেদ ধরে বসে থাকা যায় না। জেদের কথা এটা নয়; সুরেশ্বরকে সুখী করার সব রকম চেষ্টা বরং। সুরেশ্বরের সাধ পূরণ করতে, তাকে তৃপ্ত করতে, তার প্রতি হেমের ভালবাসার জন্যে যা করার সে করেছে। তার অপেক্ষা যদি অকারণ হত অর্থহীন হত তবে সে এই অপেক্ষা করতে পারত না।
গুরুডিয়ায় এসে হৈমন্তী বুঝতে পেরেছে সুরেশ্বর তাকে অকারণে অপেক্ষা করিয়েছে। সুরেশ্বর এখন পূর্বের দুর্বলতা থেকে মুক্ত। কিন্তু সে দুর্বলতা না থাকলে সুরেশ্বর কোন অধিকারে তাকে এখানে টেনে আনল?
কলকাতায় গিয়ে হৈমন্তী তার মন স্থির করে ফেলেছিল। সুরেশ্বরের আশ্রম সে এখনই ছেড়ে আসবে না। মা বা মামার কাছে সে দেখাতে চায় না, হৈমন্তীর এতদিনের বিশ্বাস ও প্রেম ব্যর্থ হয়েছে। তা ছাড়া সুরেশ্বরের সঙ্গে তার মর্যাদার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সে হেরে যেতে চায় না। সে উপকৃত এবং কৃতজ্ঞ শুধুমাত্র এই বোধেই সে সুরেশ্বরকে কিছু প্রাপ্য দিচ্ছে এ যেন সুরেশ্বর অনুভব করতে পারে।
হৈমন্তী মনে মনে ভেবে নিয়েছিল; তার এই দীর্ঘ অপেক্ষা, বিশ্বাস ও ভালবাসার মূল্য যেমন সুরেশ্বরের কাছে নেই, তেমনই সুরেশ্বরের অন্ধসেবার কোনও মূল্য তার কাছে থাকতে পারে না। এই সেবা, দয়া, ধর্ম, পুণ্য–যাই হোক, তার জন্যে সুরেশ্বরের যত দুর্বলতাই থাক হৈমন্তীর থাকবে না। সুরেশ্বরের এই অতীব দুর্বলস্থানে হৈমন্তীর পরম অবহেলা ও উপেক্ষা থাকবে।
গুরুডিয়ায় ফিরে এসে হৈমন্তী তার বিমর্ষ ভাব আর প্রকাশ করছে না। যেন তার বিমর্ষতার কোনও কারণ থাকতে পারে না। সে নিস্পৃহ, আশ্রম তার কিছু নয়, তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই আশ্রমে, রোগী এলে দেখবে, তার কাজ হাসপাতালেই শেষ, তার বাইরে নয়–এই মনোভাবে তার ভাল লাগছিল। নিজের নিঃসঙ্গতার মধ্যে সে ডুবে থাকবে না। হয়তো হৈমন্তী তাও স্থির করে নিয়েছিল। একটি-দুটি নিজস্ব সঙ্গীও তার প্রয়োজন।
.
১৫.
অন্ধ হাসপাতালের কাজের বাঁধাধরা সময় বলে এতদিন কিছু ছিল না। থাকা সম্ভবও নয়। তবু ওরই মধ্যে মোটামুটি যে সময়টা ছিল সেটা সকালের দিকে, বেলা পর্যন্ত। দেহাত, গাঁ গ্রাম, আশেপাশের পঁচিশ-ত্রিশ মাইল এলাকা থেকে একে একে রোগী এসে জুটতে জুটতে বেলা হয়ে যেত। সকালের প্রথম বাসটা গুরুডিয়ায় আসে সাতটা নাগাদ, তারপর যেটা আসে সেটা এসে পৌঁছতে সাড়ে দশ, কোনও কোনওদিন এগারোটা। যেমন করেই আসুক, যাতেই আসুক, যারা চোখ দেখাতে আসত তারা নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে এসে পৌঁছতে পারত না, হেরফের হত। হাটের দিন ইদানীং যে রকম অবস্থা দাঁড়িয়েছিল তাতে দুপুরেও রুগি আসত, দুপুরের পরও, হাটের পথেই যেন কাজটা সেরে যেত।
শীত পড়ে যাওয়ায় নানা রকম অসুবিধে হচ্ছিল। সকালের বাসে বড় কেউ এসে পৌঁছতে পারত, বাসের ভরসায় যারা বসে থাকত তাদের আসতে বড় বেলা হয়ে যেত। অন্য যারা-গোরুর গাড়িতে কিংবা লাঠটা থেকে হেঁটে আসত তারাও সব একে একে আসছে, যার যেমন সুবিধে। শীতের বেলা, দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে আসত। তার ওপর মোটামুটি কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন রোগী হলেও একটা কথা ছিল; এক একটি রোগীর পিছনে হৈমন্তীকে যে সময় ব্যয় করতে হত তাতে কলকাতার হাসপাতালে তিনটে রোগীর চোখ দেখা হয়ে যায়। দেহাতের মানুষ, যত সরল তত বোকা, আর অসম্ভব ভিতু। চোখের ওপর আলো ফেলার আগেই তাদের কী আতঙ্ক!
সাধারণত হাসপাতালের কাজ সেরে ফিরতে হৈমন্তীর দুপুর হয়ে যেতে লাগল। হাটের দিন দুপুরটাও তার হাসপাতালে কাটাতে হত। এক আধ দিন এমন হয়েছে–দুপুরের পর হৈমন্তী ফিরেছে, হঠাৎ হাটফেরত গরুর গাড়ি করে কেউ এল, ঠিক যেমন করে হাটের পর তারা বেচা-কেনার পয়সা নিয়ে স্টেশনের দোকানে সওদা করতে যায়।
স্বভাবতই, এই সব কারণে, হৈমন্তীর নানা রকম অসুবিধে হতে লাগল। স্নান খাওয়া, বিশ্রামের মোটামুটি একটা নিয়ম সে মানতে পারছিল না। অথচ দীর্ঘদিন সে এই অভ্যাস পালন করে আসছে। অসুখের পর থেকে এই ধরনের কোনও কোনও নিয়মে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, এবং এ বিষয়ে তার কিছু মানসিক দুর্বলতাও জন্মে গিয়েছিল।
একদিন দুপুরের পর, আর-একদিন হাটবারে বিকেল করে দুই রোগী আসায় সে ফিরিয়ে দিল, দেখল না। তারপর যুগলবাবুকে বলে দিল, সকাল আটটা থেকে বারোটার মধ্যে, আর হাটবারের দিন একটা পর্যন্ত যেসব রোগী আসবে শুধু তাদেরই দেখবে হৈমন্তী। এটাই হাসপাতালের নির্দিষ্ট সময়। সকলকেই এই নিয়ম মানতে হবে, যুগলবাবু যেন সকলকেই তা বুঝিয়ে দেন।
কথাটা সুরেশ্বরের কানে গেল। এর আগে রোগী ফিরিয়ে দেবার সংবাদও তার কানে গিয়েছিল। সুরেশ্বর হয়তো বিরক্ত হয়নি, কিন্তু কেন যেন ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, বিষয়টা নিয়ে হৈমন্তীর সঙ্গে তার কয়েকটা কথা হওয়া দরকার। আগে সন্ধের দিকে হৈমন্তী প্রায় রোজই তার ওখানে আসত, গল্প-টল্প করত; আস্তে আস্তে আসা-যাওয়া হৈমন্তী কমিয়ে দিয়েছিল। কিছুকাল ধরে সে বড় একটা আর আসছিল না। পুজোর পর কলকাতা থেকে ফিরে সে দু-চার বার এসেছে, কিন্তু ইদানীং একেবারেই নয়। সকালে কোনওদিন হাসপাতাল ঘরে, কোনওদিন রোগীদের ঘরের দিকে সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর দেখা হয়েছে। অন্ধ আশ্রমের নতুন কাজকর্ম নিয়ে সুরেশ্বর নিজেও খুব ব্যস্ত। আশ্রমের মধ্যে মাঠে ঘাটে দেখা হয়ে গেলেও তেমন কোনও কথাবার্তা দুজনের মধ্যে হয়নি। হৈমন্তীর সুবিধে-অসুবিধের কথা কিছু বলেনি হৈমন্তী।