হৈমন্তী বইয়ের পাতা থেকে চোখ ওঠাল, মালিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, তার সঙ্গে এর কী?
একই তো, মালিনী অবাক হয়ে বলল, এও তো অন্য লোকের বউকে ভুলিয়ে নিয়ে যাবার ফন্দি আঁটছিল।
হৈমন্তী বিরক্ত বোধ করলেও না হেসে পারল না। বলল, তুমি কিছু বুঝতে পারোনি। ভুলিয়ে নিয়ে যাবার ফন্দি কেউ আঁটেনি।
বারে, অতবার করে বলছিল।
বলেনি, লোকটা ভাবছিল। মনে মনে কী ভাবছে তা আমরা জানব কী করে, তাই মুখে বলছিল, ওটা ওর মনের ভাবনা।
মালিনী এবার যেন বুঝতে পারল, যদিও তাতে তার লাভ কিছু হল না। বলল, মনেই ভাবুক আর যাই করুক লোকটা খারাপ।
হৈমন্তী কৌতুক অনুভব করল। খারাপ তো সে কিছু করেনি।
খারাপ নয়! মালিনী চোখ বড় বড় করে তাকাল, তারপর বলল সব জেনেশুনে একজনের বউকে ঠকাচ্ছে, খারাপ নয়?
হৈমন্তী বুঝতে পারল মালিনীকে এই বিষয়টা তার পক্ষে বোঝানো মুশকিল। অনেক বকবক করতে হবে। বললেও মালিনী যে বুঝবে তা নয়। কতক সাদামাটা সরল ধারণা ও সংস্কার নিয়ে সে মানুষ হয়েছে, তাকে এত সহজে ভাল-মন্দের জটিলতা বোঝানো যাবে না। হৈমন্তী সে-চেষ্টা করল না, শুধু হেসে বলল, তুমি এসব বুঝবে না। নাও, চুপ করো। বইটা শেষ করি।
মালিনী চুপ করল। হৈমন্তী আবার বইয়ের পাতায় চোখ নামাল।
কয়েকটা লাইন পড়ল হৈমন্তী, কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও অস্বস্তি বোধ করছিল; যেন তার কিছু বলা উচিত ছিল মালিনীকে, সে বলেনি। বার বার এই উচিত বোধটা তাকে পীড়ন করছিল। হৈমন্তী অন্যমনস্ক হল, কী ভাবল সামান্য, আবার বইয়ের পাতায় মন বসাবার চেষ্টা করল। পারল না। কোথায় যেন খুঁত খুঁত করছিল। বইয়ের পাতায় আঙুল রেখে মুখ তুলে হৈমন্তী প্রথমে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর মুখ ফিরিয়ে মালিনীকে দেখল। সে যা বলতে চায় তা মালিনীর কাছে বলতে বা আলোচনা করতে তার মর্যাদায় বাধছিল। মুখে আটকাচ্ছিল। আসলে নাটকের দ্বন্দ্বটা ভালবাসার। লোভ দুর্বলতা সত্ত্বেও যা ভালবাসাই।
মালিনী পশম-বোনা থেকে মুখ ওঠাতেই হৈমন্তীর সঙ্গে চোখাচুখি হল। হেমদি তার দিকে তাকিয়ে কী দেখছে বুঝতে না পেরে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।
হৈমন্তী কেমন বিব্রত হল। চোখ সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হল না; বরং নিজের বিব্রত ভাবটা যাতে মালিনী ধরতে না পারে, জোর করে মুখে সামান্য হাসি টেনে হৈমন্তী কিছু চাপা দেবার জন্যে তাড়াতাড়ি বলল, তুমি আর কদিন লাগাবে ওটা শেষ করতে?
মালিনী পশমের বোনাটা তুলে দেখাল। হয়ে গেছে, গলার কাছটায় একটু বাকি। হাতও সেরে ফেলেছি।
শীতে পরতে পারলে হয়।
মালিনী এমন মুখ করে হাসল যেন মনে হল, হেমদি যে কী বলে! কতটুকু আর বাকি, দু-তিন দিনের মধ্যেই সব হয়ে যাবে। মালিনী কী ভেবে বলল, একটা কথা বলব, হেমদি?
না করলে কী তুমি বলবে না? হৈমন্তী কৌতুক করে হাসল।
এটা শেষ হয়ে গেলে প্রথমে আপনি পরবেন।
আমি?
পরবেন এক বেলা! …আমার খুব ভাল লাগবে।
তুমি পরলে যে আমার আরও ভাল লাগবে।
তা তো লাগবেই। আপনি আমার জন্যে এনেছেন। …আপনি একটু গায়ে দিলে আমার খুব আনন্দ হবে, হেমদি। আমি তো আপনাকে কখনও কিছু দিতে পারব না।
হৈমন্তী দুর্বলতা অনুভব করছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল। তুমি আজকাল বড় কথা বলতে শিখেছ।
মালিনীর চোখ দুটি স্নিগ্ধ সরল অথচ কত যেন কৃতজ্ঞের মতন দেখাল। মালিনী বলল, আমি কিছুই বলি না, হেমদি। আপনি রাগ করবেন ভেবে কিছু বলি না। কত কথা বলতে ইচ্ছে করে। …একটা কথা বলব?
বলো।
এবারে কলকাতা থেকে এসে আপনি কেমন একটু হয়ে গেছেন। কেমন? হৈমন্তী মুখ টিপে হাসল।
আগে আমার মনে হত আপনি আমাদের এখানে বেশি দিন থাকবেন না, চলে যাবেন। এখন মনে হয় আপনি থাকবেন।
হৈমন্তী বুঝতে পারল না মালিনীর এ ধারণা কী করে হল। এমনকী সে স্পষ্ট বুঝতে পারল না, মালিনীর আগের কথার সঙ্গে পরের কথার সম্পর্ক কী!
হৈমন্তী বলল, কলকাতা থেকে এসে আমি কী হয়েছি তাই বলো।
মালিনী যেন কী বলবে বুঝতে পারল না। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একমুখ হাসি নিয়ে বলল, আপনি আরও ভাল হয়েছেন। …আগে আপনাকে আমার ভয় ভয় করত, এখন তেমন করে না।
হৈমন্তী অন্যমনস্কভাবে বলল, কেন?
বা রে, আপনি যে আমাদের–আমাকে ভালবাসেন।
হৈমন্তী মালিনীর চোখের দিকে তাকাল।
.
রাত্রে বিছানায় শুয়ে হৈমন্তী ভাবছিল; ভাবছিল কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর সকলেই তার পরিবর্তন দেখছে। এই পরিবর্তন যে স্পষ্ট কী তা তারা জানে না, হৈমন্তী জানে। এই পরিবর্তনের অনেকটা তার ইচ্ছাকৃত, কখনও কখনও জোর করে সে কিছু প্রমাণ করতে চায়। হয়তো দেওয়ালির সময় গগন এলে হৈমন্তীকে আরও কিছু করতে হত, তাতে ইতরবিশেষ তারতম্য কী ঘটত সে জানে না। দেওয়ালির সময় গগন আসতে পারল না। মার শরীর খারাপ হয়েছিল, জ্বরজ্বালা; মামার শরীরও ইদানীং তেমন ভাল যায় না। দুজনেরই বয়স হয়ে গেছে, দুশ্চিন্তা উদ্বেগ এমনিতেই থাকে, অসুখ-বিসুখ করলে ভাবনা বাড়ে। গগন আসতে পারেনি। লিখেছে ক্রিসমাসের সময় আসবে। সেই সময়টা আরও ভাল হবে বেড়াবার পক্ষে।
গগন এখানে ঠিক যে বেড়াতেই আসছে তা নয়। মার তরফ থেকে সে কিছু বোঝাপড়া সারতে আসছে সুরেশ্বরের সঙ্গে। এই বোঝাপড়া যে কী হতে পারে হৈমন্তী তা অনুমান করতে পারে। কিন্তু মাকে সে এসব কথা বলতে চায়নি, বলেনি। বলে লাভ হত না। মা ভাবত, হেম বরাবর যা করেছে এখনও তাই করতে চাইছে, নিজের ভালমন্দ, সংসারের উদ্বেগ দুশ্চিন্তার কথা না ভেবে নিজের জেদ আর ঝোঁক নিয়ে পড়ে আছে।