বিবাহ ও দাম্পত্য জীবনের প্রথম কয়েকটা মাস তারা যেন এক ঘূর্ণির মধ্যে ছিল, কোথাও স্থিরতা বা শান্তভাব ছিল না। কিছু বিচার করেনি, ধীরে-সুস্থে পরস্পরকে দেখেনি। ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে পাক খেয়েছে। হয়ত এটা স্বাভাবিক। সদ্যপ্রাপ্ত নতুন খেলনা হাতে পেয়ে ছেলেমানুষে যেমন সব কিছু ভুলে গিয়ে খেলায় মন দেয়–এও অনেকটা সেই রকম। এমনকী নতুন খেলনা পেলে শিশুরাও যেমন অনেক সময় মনে মনে বোঝাপড়া করে পরস্পরকে খেলনাটা নিয়ে খেলতে সুযোগ দেয়, অবনী ও ললিতাও সেই রকম পরস্পরকে সুযোগ দিত।
বছর খানেক পরেই দেখা গেল সুখের স্বাদ ফিকে হয়ে আসছে। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে বসলেই আর হাতের মুঠোয় সুখের নোট কেউ গুঁজে দিয়ে যায় না। দুঃখেরও নয় অবশ্য।
কুমকুম তখনও হয়নি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হচ্ছে। কুমকুমের ভারে ললিতা ভারাক্রান্ত। ওর ইচ্ছে ছিল না–এত তাড়াতাড়ি ছেলেমেয়ে হোক। অবনীর মনে হয়েছিল, যদি হয়ে থাকে তবে তা নিয়ে ললিতার এই অশান্তি মনে মনে পুষে রাখা অনুচিত। প্রথম সন্তানের জন্যে অবনীর কেমন ঔৎসুক্য ও কৌতূহল ছিল। ললিতার তেমন কিছু ছিল না। তবে এ নিয়ে সামান্য কথাকাটাকাটি হলেও বড় রকমের কোনও ঝগড়াঝাটি হয়নি। যেটুকু অশান্তি তা ভুলে যাওয়া যায়।
কুমকুম হল। কুমকুমের জন্মের পর ললিতার সেই ক্ষুব্ধভাবটা কমল। কেমন করে যেন সে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিল। বরং অবনী ও ললিতার মধ্যে সম্পর্কের যেটুকু চিড় ধরেছিল তা সাময়িকভাবে মেরামত হয়ে গেল।
তারপর ক্রমশ, বাদুড়বাগানের বাড়িতে অশান্তি দেখা দিতে লাগল। স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যেত না প্রথমে, ধার পড়ত না; কিন্তু ধোঁয়া ধুলো নোংরা উড়ে এসে এসে যেভাবে ঘরের কোণে, দেওয়ালে ময়লা জড়ো হয়, ঝুল জমে–সেইভাবে সংসারে মালিন্য জমতে লাগল। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ত।
অবনী চেষ্টা করত ওই সব মালিন্য থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবার। চোখ ফিরিয়ে সে ললিতার দিকে তাকাত। ললিতার দেহের প্রতি তার তখনও প্রবল আসক্তি। কুমকুম হওয়ার পর ললিতার শরীর ভেঙে যায়নি, যৎসামান্য যা পরিবর্তন তাতে ললিতার প্রতি বিতৃষ্ণা জাগার কোনও কারণ ছিল না। বরং অবনীর চোখে এই পরিবর্তন ভালই লাগত।
স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ককে সে আর কোথাও যখন তেমন করে ধরে রাখতে পারছিল না, তখনও শয্যায় সে এই সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করছিল। ললিতা এক্ষেত্রে কেমন উৎসাহহীন, নিশ্চেষ্ট হয়ে আসতে লাগল। তারপর এক সময় সে অবনীর কাছ থেকে যেন সরে গেল।
এক সময় যে বাড়িতে দিবারাত্র দুরন্ত শিশুর সাড়ার মতন সুখকে অনুভব করা যেত এখন সেখানে সুখ মৃত, তার সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না, সে চলে গেছে এটা বোঝা যায়, বোঝা যায় বলেই মনে হয় সব যেন ফাঁকা। দুঃখ, এখন দুঃখকেই শুধু অনুভব করা যায়।
চোখ সরিয়ে রেখে রেখে অবনী যা দেখেনি, দেখতে চায়নি–এখন তা দেখতে সে বাধ্য হতে লাগল। দেওয়ালে, কোণে, ছাদে, ফাঁকে ফোকরে এত মালিন্য জমে গেছে যে এখন সব অস্বাভাবিক বিবর্ণ দেখায়। পুরু ধুলো, ময়লা ন্যাকড়ার মতন ঝুল, মরা কীটপতঙ্গ জমে গিয়ে যেমন দেখায় অনেকটা সেই রকম। ললিতাও এই নোংরামি দেখতে পাচ্ছিল।
সাংসারিক কলহ, অশান্তি, বিতৃষ্ণা তখন থেকেই ওদের চারপাশে ফেটে পড়ল।
ললিতার শরীরের মতন তার চরিত্রেরও কিছু স্থূলতা ছিল। অবনী যথার্থভাবে সেই স্থূলতার সঙ্গে আগে পরিচিত হতে পারেনি; এখন হচ্ছিল। নিজের চরিত্রেও অবনীর যে রুক্ষতা ও অসহিষ্ণুতা ছিল তাও প্রকাশ পেতে লাগল।
ললিতা বলত: অবনী তাকে মাংসের দরে কিনেছে।
অবনী জবাব দিত: ফুলের বাজারে বিকোবার মতন ললিতার কিছুই নেই।
ওরা পরস্পরকে বিরক্তি বিতৃষ্ণার মধ্যে নতুন করে চিনতে পারল। অবনী বুঝতে পারল, ললিতার স্বভাব অত্যন্ত নোংরা, সে হীন, স্বার্থপর, হিসেবি, দায়িত্বহীন, বিলাসী। ললিতাও বুঝতে পারল, অবনী হৃদয়হীন, অহংকারী, রুক্ষ, কামুক, উদ্ধত। উভয়ে উভয়ের সহস্র রকম ত্রুটি আবিষ্কার করতে পেরে যেন সুখী হচ্ছিল; অথবা নিজেদের সান্ত্বনা দিতে পারছিল।
পরস্পরকে নোখ দিয়ে আঁচড়াবার প্রবৃত্তি এবং হিংসা তাদের বেড়েই যাচ্ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কোনওনা-কোনও তুচ্ছতম বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হত। তারপর সেই ধোঁয়া থেকে আগুন দেখা দিত।
হয়তো সকালে ঘুম থেকে উঠে অবনী চায়ের পেয়ালায় মুখ দিয়ে দেখল চায়ের স্বাদ অত্যন্ত তেতো জুড়িয়ে জলের মতন হয়ে গেছে। বিরক্ত মুখে অবনী বলল, কী হয়েছে এটা? চা না চেরতার জল?
ললিতা জবাব দিল, যা হয়েছে তাইওর বেশি হবে না।
হবে না মানে– এক পেয়ালা চা দিয়ে আমার মাথা কিনে রেখেছ নাকি?
তুমি কি আমায় দুবেলা দুটো ভাত দিয়ে কিনে রেখেছ নাকি?
দুবেলা দুমুঠো ভাত দিয়ে যাদের কেনা যায় তুমি তাদের দলে নও। তাদের মতন হলে তবু লজ্জা থাকত।
তোমারই কত লজ্জা! …গলা ভর্তি মদ খেয়ে রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে কুকুরের মতন গা চাটতে আস, আর ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলে চোখ রাঙাও।
অবনী রাগের মাথায় চায়ের পেয়ালাটা প্রাণপণে ছুঁড়ে মারল দরজার দিকে, ভেঙে চুরমার হয়ে গেল কাপ। কুমকুম পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে বাবা এবং মাকে অবাক হয়ে দেখতে লাগল।