মালিনী বুঝতে পারত হেমদি তাকে ঠাট্টা করছে। তার মনে হত, হেমদি আজকাল অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে।
অবনী চোখে খুব একটা ভুল দেখেনি। কলকাতা যাবার আগে হৈমন্তী যা ছিল কলকাতা থেকে ফিরে ঠিক সেরকম ছিল না। তার কোথাও যেন কিছু হয়েছিল। সেটা কী–তা স্পষ্ট করে বোঝা যেত না। তবে হৈমন্তীর ব্যবহারের মধ্যে এই পরিবর্তনটা লক্ষ করা যেত। স্বভাবে সে প্রগলভা ছিল না, এখনও তার আচরণে বা কথাবার্তায় আতিশয্য ও চটুলতা নেই, তার সেই গাম্ভীর্য অটুট ছিল, নিজের কর্তব্য সম্পর্কে তার অবহেলা বা উদাসীনতাও দেখা যায়নি। তবু হৈমন্তী কোথাও যেন একটু বদলে গিয়েছিল। মালিনী যেন স্পষ্ট দেখত, হেমদি একটু অন্য রকম হয়ে গেছে। এতে তার সুবিধে বই অসুবিধে হয়নি। দুজনের মধ্যে সম্পর্কের একটা আড়াল আগে ছিল, মালিনী কখনও সেই বেড়া টপকাতে সাহস করেনি। এখন তার মনে হয়, সে সাহস তার হয়ে যাচ্ছে, চেষ্টা করলে সে বেড়া টপকাতে পারে। হয়তো হেমদি পছন্দ করবে না, কিন্তু কিছু বলবেও না।
আগের চেয়ে হেমদিকে এখন ভালই লাগছিল মালিনীর। আগে যেসব কথাবার্তা না বুঝে বলতে গিয়ে সে হেমদির কাছে চোখের ধমক খেয়েছে বা যেসব তুচ্ছ কথা ভাল লাগে বলে বলতে এসে হেমদির তরফ থেকে কোনও সাড়া পায়নি–এখন ভুল করে সেসব কথা বলে ফেললেও হেমদি দু-চারটে কথা বলে বা হাসে। মালিনী কোথাও যেন খানিকটা প্রশ্রয় পাচ্ছিল।
সেদিন হৈমন্তীর ঘরে বসে মালিনী নাটক শুনছিল। বাইরে দেখতে দেখতে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। বিছানায় আধ-শোওয়া হয়ে হৈমন্তী ইংরাজি গল্পের বই পড়ছিল, মাথার কাছে সুন্দর একটা শেড দেওয়া বাতি জ্বলছে। হৈমন্তী এবার কলকাতা থেকে এটা এনেছে, লণ্ঠনের সেই মেটেমেটে আলোতে ঘরটা এ-রকম দেখাত না, কাচের সাদা শেড পরানো এই নতুন বাতিতে অনেক সুন্দর পরিষ্কার দেখাচ্ছে।
মালিনী রেডিয়োর সামনে ছোট একটি টুলে বসে। কোলে পশম, হাতে কাঁটা। নাটক শুনতে শুনতে তার পশম বোনা থেমে গিয়েছিল। হৈমন্তী তাকে কলকাতা থেকে উল এনে দিয়েছে, মালিনী বলেনি, নিজেই এনেছে হৈমন্তী, এনে নিজের হাতে নতুন একটা বোনা শিখিয়ে দিয়ে বলেছে, শীতের আগে শেষ করে ফেলল। গায়ে দেবে।
বোনা প্রায় শেষ, এতদিনে শেষ হয়েও যেত, কোথায় একটা গোলমাল হয়ে যাওয়ায় অনেকটা খুলে ফেলতে হয়েছিল, আবার বুনতে হচ্ছে। দু-একদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
নাটক যখন হচ্ছিল হৈমন্তী মাঝে মাঝে বই বন্ধ করে শুনছিল, আবার পড়ছিল। নাটক শেষ হয়ে যাবার মুখে বইটা বন্ধ করে বালিশের পাশে রেখে হৈমন্তী সোজা হয়ে বসল। তার পা ছড়ানো, হাঁটু গুটোনো, পিঠ সামান্য নোয়ানো, দুটি হাত দুপাশ থেকে হাঁটুর কাছে এসে আঙুলে আঙুলে জড়ানো। রেডিয়োর দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে শেষটা শুনছিল। মালিনীও শুনছে।
সামান্য পরেই নাটক শেষ হল। মালিনী এতক্ষণ যে নিশ্বাস চেপে রেখেছিল এবার শব্দ করে সেই নিশ্বাস ফেলল, মুখটি কয়েক মুহূর্ত কেমন অন্যমনস্ক দেখাল।
নাটকের পর কী যেন একটা শুরু হয়েছিল, হৈমন্তী রেডিয়ো বন্ধ করে দিতে বলল। মালিনী বন্ধ করে দিল। তাকে রেডিয়ো খুলতে বা বন্ধ করতে বললে মালিনী ছেলেমানুষের মতন এক সুখ পায়। হৈমন্তীর কাছে দেখে দেখে এ দুটো জিনিস সে শিখেছে।
হৈমন্তা ছোট করে হাই তুলল, তুলে আলস্য ভেঙে বিছানা থেকে নামল। তার গায়ে মেয়েলি, সাধারণ একটা শাল জড়ানো, শালের রংটি ঘন কালো। গায়ের সাদা শাড়ির ওপর কালোটি আরও প্রখর হয়ে ফুটছিল। হৈমন্তী আজ চুল বাঁধেনি, এলো করে ঘাড়ের কাছে জড়িয়ে রেখেছিল।
মালিনী কী যেন বলব বলব করছিল, কিন্তু চটিটা পায়ে গলিয়ে টর্চটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে হেমদি কলঘরে যাচ্ছে বলে এখন কিছু বলল না।
একটু পরেই হৈমন্তী ফিরে এল। ফিরে এসে বলল, বাইরে বেশ শীত পড়েছে।
মালিনী মাথা নাড়ল, যেন সে জানে বাইরে বেশ শীত
পড়েছে। হৈমন্তী আবার বিছানায় উঠে বসল।
মালিনী বলল, শেষটায় যে কী ছাই হল বুঝলাম না।
হৈমন্তী কথার জবাব না দিয়ে বালিশের ওপর থেকে বইটা আবার তুলে নিল।
মালিনী হৈমন্তীর জবাবের প্রত্যাশায় থেকে শেষে বলল, লোকটা কি পালিয়ে গেল?
পালিয়ে যাবে কেন, মরে গেল, গাড়ি চাপা পড়ে…
ও! ..কী জানি, আমি ভাবলাম পালিয়ে গেল।
তুমি ওই রকমই ভাব।
মালিনী অপ্রস্তুত হল না, লজ্জাও পেল না। বরং হেসে বলল, অত গাড়ির শব্দ চেঁচামেচিতে কি কিছু বোঝা যায়। তার ওপর খালি ইংরাজি বলছে।
হৈমন্তী বইয়ের পাতা হারিয়ে ফেলেছিল, খুঁজতে লাগল।
কথা বলার লোক সামনে থাকলে মালিনী বেশিক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। বলল, হেমদি, আমি এই রকম একজনের কথা জানি৷
হৈমন্তী তার হারানো পাতা খুঁজে পেল। রহস্যটা এখনও মাঝামাঝি অবস্থায়।
শ্রোতার মনোযোগর ওপর মালিনীর লক্ষ ছিল না, সে ঘটনাটা বলতে লাগল। অনেক দিন আগে, বুঝলেন হেমদি, আমরা তখন ছোট, এদিকে এত বাড়ি-টাড়িও হয়নি; তখনও লোকে পুজোর পর শীতের দিকে এখানে শরীর সারাতে আসত। একবার একজনরা এল–স্বামী স্ত্রী। দুজনেই দেখতে বেশ সুন্দর। খুব ঘুরত বেড়াত, হাটবাজার করত, কলের গান বাজাত; বউটা কত রকম করে যে সাজত! ওরা বলত শরীর সারাতে এসেছে। বেশ ছিল দুটিতে। হঠাৎ একদিন হই হই, ওদের বাড়ির সামনে কী ভিড়, পুলিশ-টুলিশ পর্যন্ত এসে পড়ল। ওমা, শেষে শুনলাম, ওই বউটা অন্য লোকের বউ, এর সঙ্গে চলে এসেছে; যার বউ সে খোঁজ পেয়ে হঠাৎ এসে হাজির। বাব্বা, সে কী কাণ্ড!