অবনী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
হৈমন্তী হাতঘড়ি দেখল। ছটা বাজতে চলল, ওঁরা তো আসছেন না।
উমেশবাবুর বাড়ি খানিকটা দুর। দেখা করতে গিয়ে হয়তো কথাবার্তা বলছেন।
আপনি ভদ্রলোককে চেনেন?
দেখেছি, আলাপ নেই।
হৈমন্তী কয়েক মুহূর্ত কী যেন দেখল অবনীর, তারপর কৌতূহল প্রকাশ করল, আপনার সঙ্গে এখানকার লোকজনদের তেমন মেলামেশা নেই, না?
অবনী কোনও জবাব দিতে পারল না, পরে বলল, কিছু কিছু আছে।
আপনি বোধহয় তেমন আলাপি নন হৈমন্তী হেসেই বলল, আপনার খুব বদনাম।
অবনী চমকে উঠল না, কিন্তু বিস্ময় বোধ করল।
হৈমন্তী বলল, লোকে আপনাকে ভয় পায়। অহঙ্কারি মনে করে। করে না?
মালিনী বলেছে?
শুনি তো সে রকম, হৈমন্তী সরল গলায় বলল। কী মনে পড়ায় আবার বলল, মালিনী আপনার কাছে খুব কৃতজ্ঞ। তার ভাইকে আপনি কী যেন করে দিয়েছেন, মাইনে বেশ কিছু বেড়ে গেছে।
ছেলেটি বোকা, কিন্তু ভাল।
ভাল কথা, শুনলুম, আপনি বদলি হয়ে যাচ্ছেন নাকি?
এ-খবরও নিশ্চয় মালিনীর?
একা সে-বেচারিকে দোষ দিচ্ছেন কেন?
অবনী অনুমান করে নিল, বিজলীবাবু মারফত কথাটা সুরেশ্বরের কানে উঠেছে। হয়তো সুরেশ্বরও বলেছে হৈমন্তীকে। সুরেশ্বরের আশ্রমে সে কী আজকাল আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে? বিজলীবাবু কী অবনী সম্পর্কে আরও কোনও সংবাদ দিয়েছেন। বিজলীবাবুর ওপর অবনী অসীম বিরক্তি অনুভব করল।
বদলির কথা ঠিক নয়–অবনী বলল, অন্য একটা কথা হচ্ছিল; সেটা হলে আমায় অন্য জায়গায় যেতে হবে।
শুনেছি। হায়ার পোস্ট।
তবে তো সবই শুনেছেন। …আমায় নিয়ে এত আলোচনা হয় নাকি?
না, কথা উঠলে ওঠে।
অবনী আর কিছু বলল না। তার ভাল লাগছিল না।
উভয়ে আবার নীরব হল। দেখতে দেখতে ধূসরতা গাঢ় হয়ে সিস-পেনসিলের দাগের মতন অন্ধকার জমছে। আলো মুছে এল। রাস্তা দিয়ে কারা যেন বকবক করতে করতে চলে গেছে। বারান্দা অন্ধকার হয়ে এল।
আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর অবনী বলল, বাতিটা জ্বেলে দিই।
অবনী উঠে গিয়ে বাতি জ্বালল বারান্দার।
হৈমন্তী আলোর মধ্যে দুদণ্ড বসে থাকল। যেন সহসা এই ধূসরতা ও অস্পষ্টতা ঘুচে যাবার পর সে নিজেকে আলোর মধ্যে সইয়ে নিচ্ছে। আশ্রমের মিটমিটে আলোর তুলনায় এই আলো যেন অনেক সুন্দর, পরিষ্কার করে সব চোখে পড়ে। কলকাতার বাড়ির আলোও আবার এরকম নয়, সেখানে পথঘাট পাশের বাড়ি সর্বত্র থেকে আলো এসে নিজের বাড়ির আলোকে ভাসিয়ে দেয়, মনে হয় না নিভৃতে নিজের মতন করে একটু আলো জ্বালোম। এখানে, এই মুহূর্তে হৈমন্তীর এই আলোটুকু ভাল লাগল; ক্ষীণ নয়, অতি উজ্জ্বলও নয়; অতি অস্পষ্ট নয় আবার প্রকাশ্য নয়, নিভৃত অথচ আপন।
.
১৪.
দেখতে দেখতে দেওয়ালি পেরিয়ে শীত পড়ে গেল। শীতের এই শুরু এখানে অত্যন্ত মনোরম। আর্দ্রতার লেশমাত্র কোথাও নেই; আকাশ জুড়ে নীলের আভা, বাতাস শুকনো, সারারাত হিম আর শিশির ঝরে তৃণলতা বৃক্ষ যেটুকু সিক্ত হয় সকালের উজ্জ্বল রোদে তা শুকিয়ে গেলে সতেজ পরিচ্ছন্ন এক সবুজের দীপ্তি ফুটে ওঠে। এখনও উত্তরের বাতাস তেমন করে হানা দেয়নি, তবু শীতের দমকা এলোমেলো বাতাস বনের দিক থেকে মাঝে মাঝে ছুটে আসে, এনে শনশন শব্দ তুলে গাছ লতাপাতা বিশৃঙ্খল ও শিহরিত করে চলে যায়। গুরুডিয়ার শালবন এতদিন যেন ঘুমিয়ে ছিল, সাড়াশব্দ পাওয়া যেত না। এখন প্রায় রোজই সকালে দু-চারটে বয়েলগাড়ি কাঁচা পথ উঁচু-নিচু মাঠ দিয়ে শালের জঙ্গলে চলে যায়, চাকার নিরবচ্ছিন্ন চিকন শব্দের সঙ্গে বয়েলের গলার ঘণ্টা বাজে ঠুং ঠুং তারপর সারা দুপুর বাতাসে কাঠুরেদের কাঠ কাটার শব্দ; কখনও কখনও সেই শব্দ স্তব্ধ দুপুরে অন্ধ আশ্রমেও ভেসে আসে। বিকেল পড়ে আসার আগে আগেই গাড়িগুলো ফিরে যায়। দু-তিন দিন ধরে ওরা শুধু গাছ কাটে, তারপর একদিন গাড়ি বোঝাই করে ফেরে। লুটোনো শালের শাখা-প্রশাখার পাতায় পথের ধুলো ওড়ে অল্প, মাটিতে আঁচড় লেগে থাকে।
বিকেল যেন দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায়, গাঢ় রোদ ফিকে হয়ে আসার আগেই কেমন এক অবসন্ন ভাব। নরম আলো গায়ে মেখে পাখিরা বনের দিক থেকে ফিরতে শুরু করে, ছায়া জমতে থাকে আড়ালে; আমলকীর চারা, আতাগাছের ঝোপ দিয়ে জঙ্গলা ফড়িং, দু-চারটি প্রজাপতি তখনও বুঝি নাচানাচি করে; তারপর শীতের দমকা বাতাস এসে গাছ লতাপাতা সরসর শব্দ তুলে বয়ে গেলে মাঠ থেকে, গাছগাছালি থেকে শেষ আলোটুকু পালিয়ে যায়, অন্ধ-আশ্রমের সবজিবাগানের গন্ধ ভেসে আসে, সারের গন্ধ, মাটির গন্ধ এবং শীতের গন্ধ। গোধূলিটুকুও ফুটতে পারে না, ছায়া এবং অন্ধকার এসে সমস্ত কিছু ঢেকে ফেলে।
শীতের শুরুতেই অন্ধ আশ্রমের নতুন কয়েকটা কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। একটা নতুন কুয়ো খোঁড়ানো হচ্ছিল, কুয়ো খোঁড়ানো শেষ হলে সেটা বাঁধানো হল। নতুন একটা চালা তৈরি হচ্ছে একপাশে, আর-একটা তাঁত ঘর বসবে। রাঁচি থেকে তাঁত আসছে। সুরেশ্বর আর শিবনন্দনজি মিস্ত্রি মজুর, ইট কাঠ নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত।
হৈমন্তীর এ-সব বিষয়ে কোনও আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না। তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকটা তফাতে আশ্রমের এই নতুন কাজগুলি দেখা যায়; হৈমন্তী দেখেছে অবশ্য, কিন্তু কোনও রকম উৎসাহ অনুভব করেনি। বরং কৌতুক অনুভব করেছে কেমন, মালিনীকে বলেছে, তাঁতের কাজটা তুমিও শিখে নিও, মালিনী।