আরও কয়েক মাস দেখা যাক। যদি ললিতা না শুধরোয় তবে কুমকুমকে কোনও ভাল মিশনারি মেয়েদের হোস্টেলে রেখে দিতে হবে।
পরের চিঠিতে, অবনী স্থির করে নিল, কমলেশকে লিখতে হবে কলকাতার কোনও উকিলের কাছে গিয়ে ডিভোর্স সম্পর্কে পরামর্শ নিতে।
.
১৩.
সেদিন, রবিবারের বিকেলের দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে সুরেশ্বর ও হৈমন্তী এসে হাজির। সঙ্গে বিজলীবাবু। অবনী বারান্দায় বসে অফিসের কাগজ দেখছিল। ফটক খোলার শব্দে সামনে তাকিয়ে ওদের দেখল। উঠে গিয়ে অভ্যর্থনা করল, আসুন।
বিজলীবাবুই কথা বললেন প্রথম, মিত্তিরসাহেব কি অফিস নিয়ে বসেছিলেন নাকি?
না, না, একটা কাগজ দেখছিলাম।
সিঁড়িতে সুরেশ্বর আর বিজলীবাবু, সামান্য পেছনে হৈমন্তী। হৈমন্তী আশপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, গাছপালা, বাগান, বাড়ি। এর আগে সে কখনও এই বাড়িতে আসেনি।
বসার ঘরে এনে বসাতে চাইছিল অবনী, সুরেশ্বর বলল, এখন আর বেশিক্ষণ বসব না, আমার একটা কাজ সারার আছে; উমেশবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করতে যাব; উনি কাল পাটনায় ফিরে যাচ্ছেন।
উমেশবাবুর পরিচয়টা এখানকার সকলে জানে, অবনীও জানে। ভদ্রলোক পাটনা হাইকোর্টে জজিয়তি করেছেন এক সময়, এখন অবসর-জীবন যাপন করেন। পাটনা শহরের দু পুরুষের বাস, ভাইবোন ছেলে সবাই কৃতিপুরুষ, সকলেই প্রায় পাটনায় থাকে। অভিজাত পরিবার, পাটনার গণ্যমান্য ব্যক্তি। শোনা যায়, দেবতুল্য মানুষ উমেশবাবু। পুজোর সময় এখানে আসেন, বাড়ি আছে, সপ্তাহ দুই থাকেন, তারপর আবার ফিরে যান। এই সময়টুকুর মধ্যে উচ্চনীচ ভেদে সকলের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় রক্ষা করেন, পাঁচজনের অনুরোধ-উপরোধ শোনেন, সাধ্যমতো উপকারও করেন। প্রবাসী বাঙালি বলেই বোধহয় বাঙালিপ্রীতি কিছুটা বেশি।
অবনীর সঙ্গে উমেশবাবুর পরিচয় নেই, সে কখনও পরিচিত হতে যায়নি, তার তেমন কোনও ইচ্ছেও হয়নি। সুরেশ্বর কেন উমেশবাবুর কাছে যাবে অবনী তা অনুমান করতে পারল। উমেশবাবু সুরেশ্বরের বিশেষ অনুরাগী বলে সে শুনেছে, তা ছাড়া উমেশবাবু পাটনার সরকারি মহলে বলে কয়ে সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রমের জন্যে কোনও কোনও বিষয়ে সাহায্যের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।
মহিন্দরকে ডেকে অবনী বাইরে আরও চেয়ার দিতে বলল।
বিজলীবাবু বললেন, আমি বলি কি, উঠব উঠব মন নিয়ে বসার চেয়ে কাজটা সেরে এসে হাত পা ছড়িয়ে বসাই ভাল। বিকেলও তো যাই-যাই করছে। বলে তিনি সুরেশ্বরের মুখের দিকে তাকালেন।
মনে হল সুরেশ্বরেরও সেই রকম ইচ্ছে। অবনীর দিকে তাকিয়ে বলল, বিকেলের বাসে এসেছি, বিজলীবাবুর বাড়িতে না বসে এলে উনি আমাদের দিকের বাস বন্ধ করে দেবেন বলে শাসিয়েছিলেন–
সুরেশ্বর হাসল। হাতে খুব একটা সময়ও নেই, সন্ধের বাসে ফিরব। আমরা বরং দেখা করেই আসি। হেম বসুক।
অবনী বলল, বসুন, ফেরার জন্যে ব্যস্ত হতে হবে না।
সুরেশ্বর অনুমান করতে পারল অবনী কী বলতে চায়।
না, আমাদের পৌঁছে দিতে আবার আপনি গাড়ি নিয়ে যাবেন, তা হয় না; অকারণ কষ্ট…
কষ্টর কিছুনা। আমিও হয়তো যেতাম আজ। বলে অসতর্কভাবে হৈমন্তীর দিকে তাকাল পলকের জন্যে।
বিজলীবাবু বললেন, আপনি এমন করেন মহারাজ, যেন জলে পড়েছেন। আমরা তো রয়েছি, সন্ধের বাস ধরার জন্যে অত উতলা হচ্ছেন কেন!
সুরেশ্বর একটু ভাবল, বলল, তা হলে কাজটা সেরে এসে বসি। উমেশবাবু কাল চলে যাবেন, বাড়িতে লোকজনের ভিড় থাকতে পারে।
সামান্য বসে সুরেশ্বর ও বিজলীবাবু চলে গেলেন।
হৈমন্তীর সঙ্গে বিশেষ কোনও কথাবার্তা এতক্ষণ হয়নি, এবার অবনী বেতের চেয়ারটা একটু পিছন দিকে সরিয়ে হৈমন্তীর মুখোমুখি হয়ে হেসে বলল, বলুন, তারপর আপনার খবর কী? কেমন বেড়ানো হল?
বেড়ানো কোথায়, বাড়ি ঘুরে এলাম, হৈমন্তীও হাসিমুখে জবাব দিল।
আপনি ফিরেছেন শুনেছি, কিন্তু গত সপ্তাহটা অফিসের কাজে নিশ্বাস ফেলার সময় পাইনি। গাধার মতন খাঁটিয়ে নিয়েছে। নতুন একটা কনস্ট্রাকশানের কথা চলছে, দুবেলা বিশ বাইশ মাইল ছুটোছুটি। …চাকরি জিনিসটা বড় হিউমেলেটিং। ..যাকগে, আপনার খবরাখবর বলুন। একদিন আপনাদের ওখানে গিয়েছিলাম।
শুনেছি, মালিনী বলেছে।
কিছুই নয়, তবু মালিনীর নামে অবনী কেমন অপ্রস্তুত বোধ করল। সেদিন ঠিক কী মানসিক অবস্থায়, কতটা হুঁশ হারিয়ে হৈমন্তীর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মালিনী জানে না। সে অবনীকে কী ভাবে দেখেছে, কী মনে করেছে কে জানে! অবনী বুঝতে পারল না, মালিনী হৈমন্তীকে আরও কিছু বলেছে কিনা।
অবনী সামান্য চুপ করে থেকে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলল, কেমন লাগল কলকাতা?
কেমন আর লাগবে, যেমন লাগে হৈমন্তী ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল।
এই জঙ্গল থেকে হঠাৎ কলকাতায় গিয়ে খানিকটা অন্য রকম লাগার কথা।
তা লেগেছে; ভালই লেগেছে।
এখানে ফিরে এসে এখন কেমন লাগছে? অবনী ঠাট্টা করেই বলল।
আগের মতনই।
আপনাকে কিন্তু এবারে একটু অন্য রকম দেখাচ্ছে।
তাই নাকি? কী রকম? হৈমন্তী চোখের পাতা তুলে বলল।
কী রকম…! মানে…বেশ খানিকটা রিফ্রেশড দেখাচ্ছে।
ও। হৈমন্তী অল্প একটু হেসে থেমে গেল।
চাকরে চায়ের ট্রে দিয়ে গেল, বিস্কিট, ডিম, মিষ্টি। হৈমন্তী তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে না না করল। খাবার না, বিজলীবাবুর বাড়িতে ওঁর স্ত্রী এমন করে পেড়াপেড়ি করলেন…সত্যি, আমি কিছু আর খেতে পারব না।