মার স্বভাব, চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি, অহংকার–এসব যেমনই হোক, একটা বিষয়ে মার কোনও কার্পণ্য ছিল না। শেষ দিন পর্যন্ত মা অবনীকে কোনও রকম আর্থিক অভাব বা দুঃখ কষ্ট সাধ্যমতো বুঝতে দেয়নি, ছেলেকে মা সচ্ছলতার মধ্যে মানুষ করেছে, লেখাপড়া শেখানোতেও ত্রুটি রাখেনি।
মার মৃত্যুর পর অবনী এক অদ্ভুত রকমের মুক্তি পেল। পায়ে শেকল পরানো পাখি দীর্ঘকাল বন্দী থাকলে তার পা যেমন অসাড় হয়ে আসে, অবনীও সেই রকম প্রথম দিকটায় তার মুক্তিকে ভয়ে ভয়ে দেখেছে, সে সাহস পায়নি পা বাড়াবার। তারপর সংশয় দুর হলে সে পা বাড়িয়েছে, কিন্তু বেশি দূর নয়। কেমন করে যেন মার প্রভাব তার রক্তে মিশে গিয়েছিল, মনের কিছু যেন কুঁকড়ে রেখেছিল, অবনী তা অগ্রাহ্য করতে পারত না। শেষ পর্যন্ত সে বেপরোয়া মরিয়া হয়ে নিজের স্বাধীনতার জন্যে লাফিয়ে পড়ল, কিন্তু সে যেখানে পা রাখল সেটা খানিকটা তার সাজানোবাবার জায়গা, খানিকটা মার। একদিকে সে একা, নিঃসঙ্গ, নিগৃহীত, ক্লান্ত, বিরক্ত; অন্য দিকে সে তীব্র, নির্দয়, সুখান্বেষী, ভোগবিলাসী। নিজের মেরুদণ্ডকে সোজা করতে গিয়ে সম্ভবত সে সামঞ্জস্য ভুলে গিয়েছিল, এবং এমনভাবে তার মেরুদণ্ড সোজা করল যেটা স্বাভাবিক নয়, ফলে সেই কৃত্রিম অনভ্যাস-দৃঢ় মেরুদণ্ড হল তার ঔদ্ধত্য।
নিজের শৈশবের এই স্মৃতি সুখের নয়, কাম্যও নয়। অবনী চায়নি, কুমকুমের শৈশবও তার বাবার মতন সিসের চৌবাচ্চার মধ্যে কাটে। নিশ্বাস-প্রশ্বাস নেবার জন্যে খানিকটা বাতাস সেখানে আসার মতন ব্যবস্থা থাকবে হয়তো, কিন্তু আর কিছু না। নোংরামি, কদর্যতা, গ্লানি, ইতরতা ছাড়া কুমকুম আর কিছু পাবে না। স্নেহ, ভালবাসা, কোমলতা–এসব কিছু নয়। অথচ ললিতা কুমকুমকে ছাড়ল না। অবনীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। যে-কোনও মূল্যে সে বুঝি তখন মুক্তি চায়। ললিতাই শেষ পর্যন্ত জিতে গেলে।
.
কমলেশের জবাব আসতে সামান্য দেরি হল।
কমলেশ লিখেছে, সে কলকাতায় ছিল না, দিন তিনেকের জন্যে পুরী গিয়েছিল, ফিরে এসে অবনীর চিঠি পেয়েছে। পেয়ে ললিতাদের বাড়ি গিয়েছিল। প্রথম দিন ললিতার দেখা পায়নি, পরে আবার গিয়ে দেখা করেছে।
অনেক দিন পর ললিতাকে দেখলাম,কমলেশ লিখেছে, পাঁচ ছ মাস পরে। আগে পথে ঘাটে মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হত, আজকাল হয় না, আমি যে বাড়ি বদলেছি তা তো তুই জানিস। কুমকুমের কথা আগে বলি। এখন সে ভাল আছে, তবু শরীর খুব রুণ। তাকে আড়ালে যতটুকু বলার বলেছি, বেশি বলা উচিত হত না। জামা-টামা কিনে দিয়েছি, কিন্তু ললিতার কাছে একথা শুকোনো যায়নি যে, তোর কথা মতন আমি কিনে নিয়ে গিয়েছি। কুমকুমের ওপর ললিতা সন্দেহ করেনি, ভেবেছে তোর খেয়াল হওয়ায় তুই কিনে দিতে বলেছিস। ব্যাপারটা এর বেশি কিছু গড়ায়নি। ..ললিতার বিষয়ে কয়েকটা কথা জানাচ্ছি, তোর ইন্টারেস্ট থাক না থাক কথাটা জেনে রাখা উচিত। ললিতা আজকাল অবাঙালি এক সেলস ম্যানেজারের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় থাকে, সেখানে একটা চাকরিও করে শুনলাম। আমার খুবই সন্দেহ; ললিতা রীতিমতো মদটদ খেতে শুরু করেছে। তার চোখ মুখ দেখলে সেরকম মনে হয়, কথাবার্তা শুনলেও। শরীর ভেতরে ভেতরে নষ্ট হয়ে গেছে, ওপরে তা ঢাকা দিয়ে এ-সমস্ত ক্ষেত্রে মেয়েরা যা করে বেড়ায় তাই করে বেড়াচ্ছে। মেয়ের সম্পর্কে তার তেমন কোনও উৎসাহ নেই, দায়-দায়িত্বও দেখলাম না। মেয়ের ওপর যত্ন নিতে বলায় বলল, এর বেশি যত্ন নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেবার কথা আমি বলিনি–আমার পক্ষে সেটা বলা ভাল দেখাত না। …আমার মনে হয়, এ-বিষয়ে তোর নিজের কিছু লেখাই ভাল। তবে, ললিতার কাছে মেয়ে রাখা যে একেবারেই উচিত নয় তা আমি বলতে পারি। …এ ব্যাপারে যা ভাল হয় করিস।
কমলেশের চিঠি পড়ে অবনী বুঝতে পারল না, সে কী করবে, কী তার করা উচিত।
ললিতাকে চিঠি লিখতে তার আগ্রহ হল না। কমলেশের কাছে খবর পেয়েই যেন সে লিখছে এভাবে লেখা যেত, (কুমকুম আড়ালেই থাকত) কিন্তু অবনীর তেমন কোনও ইচ্ছাই হল না। ললিতার ওপর তার ঘৃণা আর নতুন করে বাড়ার কিছু নেই, সে মদ খাক, আর পাঁচটা লোকের সঙ্গে শোয়া বসা করুক তাকে অবনীর কিছু আসে যায় না। এটা সে আগে করত, পরে করবে। ললিতার স্বভাব বদলাবে এমন প্রত্যাশা সে কখনও করবে না। ললিতার জন্যে তার মাথাব্যথা অনাবশ্যক। কিন্তু কুমকুম? কুমকুমের কী হবে?
হয় কুমকুমকে তার মার হাতে ছেড়ে দিতে হয়, যেভাবে ললিতা তাকে মানুষ করবে সেইভাবেই সে মানুষ হবে, (অবনী যেমন হয়েছিল। তবে, অবনীর মার সঙ্গে ললিতার তুলনা চলে না, অন্তত সন্তান পালন সম্পর্কে নয়) আর না হয়, কুমকুমকে ললিতার কাছ থেকে নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু কোথায় আনবে? এখানে? এখানে আনা কি সম্ভব? কে দেখবে তাকে? হঠাৎ তার মেয়ে এল কোথা থেকে এই রহস্য এখানের মানুষগুলোকে চঞ্চল ও উত্তেজিত করবে। কুমকুমকে পাঁচ রকম প্রশ্ন করবে লোকে। তা ছাড়া কুমকুম যে তার কাছে আসতে চাইবে এরই বা স্থিরতা কী! ললিতা নিশ্চয় সহজে মেয়েকে ছাড়তে চাইবে না।
অনেক ভেবে অবনী স্থির করল, এখন যেমন আছে কুমকুম তেমনই থাক। কমলেশ ললিতার সঙ্গে দেখা করার পর হয়তো ললিতা কিছু আঁচ করতে পারছে। সে যথেষ্ট চালাক। মেয়ে হারানোর অর্থ ললিতার মাসে মাসে বাঁধা রোজগার হারান। হয়তো সেটা সে অনুমান করে কুমকুমের ওপর কিছুটা নজর দেবে।