চিঠিটা পুজোর মধ্যেই পাঠিয়ে দিয়েছিল অবনী, টাকাও পাঠিয়েছিল। অবশ্য কমলেশকে টাকা না পাঠালেও চলত, বলা যায় না সে হয়তো একটু অসন্তুষ্টই হবে। ললিতার সঙ্গে ছাড়াছাড়ির সময় কমলেশ অনেক করে বলেছিল, মেয়ে ছাড়িস না–মেয়েটাকে একেবারে নষ্ট করে দেবে। তোরই মেয়ে
কমলেশের কাছ থেকে চিঠির জবাব আসবার আগেই বিজলীবাবুর কাছে অবনীকে স্বীকার করে নিতে হল কলকাতায় তার মেয়ে আছে, স্ত্রীও আছে-যদিও তাদের সঙ্গে তার আর কোনও সম্পর্ক নেই।
বিজলীবাবু যে কী বুঝেছিলেন কে জানে, স্ত্রী অথবা মেয়ের সম্পর্কে আর কোনও প্রশ্ন করেননি। অথচ অবনী বেশ বুঝতে পারছিল, বিজলীবাবু যেন কোথায় একটা অপ্রত্যাশিত বিস্ময়-বোধ নিয়ে রয়েছেন, হয়তো নিজে সন্তানহীন বলে অবনীর সন্তানের প্রতি এই উপেক্ষা তাঁর কাছে নির্মম মনে হচ্ছিল। অবনীর একসময়ে মনে হয়েছিল, বিজলীবাবু হয়তো অনুমান করছেন, স্ত্রীর চরিত্র এবং সন্তানের জন্ম রহস্য সম্পর্কে অবনীর কোনও সন্দেহ আছে, সেই সন্দেহবশে অবনী স্ত্রী কন্যা ত্যাগ করেছে। বিজলীবাবু অন্য আর কী ভাবছেন, ভাবতে পারেন অবনী জানে না। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, বিজলীবাবুর কাছে অবনী ইদানীং কেমন অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছিল। যেন তিনি অবনীর অত্যন্ত গোপন কিছু জেনে ফেলেছেন যা সে জানাতে চায়নি। ভদ্রলোক তার ভেতরে কোন অবনীকে দেখছে, মাঝে মাঝে এই বিরক্তিকর চিন্তা এসে অবনীকে অন্যমনস্ক ও কুণ্ঠিত করছিল। অন্তত, বিজলীবাবু যদি ভাবেন, কুমকুম জারজ–এই ভয় ও আশংকা অবনীকে কেমন পীড়িত ও লজ্জিত করছিল। আত্মসম্মান ও কুমকুমের মর্যাদার জন্যে অবনীর কী করণীয় সে বুঝে উঠতে পারছিল না।
নিজের শৈশবের দিকে তাকালে অবনী যাদের দেখতে পায় তাদের কেউই তার কাছে সম্মানীয় নয়। বাবা এবং মার মধ্যে যথার্থ সম্পর্ক কী ছিল অবনী অনেক দিন তা বুঝতে পারেনি। পরে বুঝেছিল। বুঝে তার ঘৃণা হয়েছিল, মার ওপর, বাবার ওপর, নিজের ওপর। বাবার মতন অপদার্থ মানুষ হয়তো সংসারে কিছু কিছু থাকে, কিন্তু তার বাবা ছিল সমস্ত রকমে অপদার্থ। নিজের মেরুদণ্ডকে কখনও সোজা করেনি, করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিল; কখনও সখনও হয়তো অসহ্য হলে বাবা ভেবেছে একটু নড়েচড়ে উঠবে, কিন্তু এরকম কিছু হবার উপক্রম হলেই যেন মা জানতে পারত, এবং খুব সহজেই মা বাবার সেই অসাড় রুগণ মেরুদণ্ডকে আবার বেঁকিয়ে দিত। মার কাছে বাবার কোনও অস্তিত্ব ছিল না; কখনও সখনও মনে হত, সার্কাসের তাঁবুর মধ্যে বাবাকে নেশাখোর নির্জীব বাঘের মতন এনে দাঁড় করিয়ে মা চাবুক হাতে খেলা দেখাচ্ছে। মা কখনও সেই চাবুক ছুড়ত না, এমনকী তার শব্দও শোনা যেত না, অথচ বাবা মার খেলার কৌতূহলটুকু জোগান দিত, প্রয়োজনে মার ইঙ্গিতে বাবা হুঙ্কারও করত। দর্শকের কাছে যেন মার কৃতিত্বের জন্যে এই হুঙ্কার প্রয়োজন ছিল। মাকে এসব দিক থেকে অসামান্য মনে হত, মনে হত মার অসাধ্য কিছু নেই। মার স্বভাব যে কত প্রখর ছিল এবং ব্যক্তিত্ব কী উগ্র তা বাবার পাশে মাকে দেখলে বোঝা যেত। অবনী ছেলেবেলায় মাকে ভাল বুঝত না, পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখেছে মা সমস্ত কিছু গ্রাস করে আছে। মার ব্যক্তিত্বের কাছে বাবা নিষ্প্রভ। সংসারে যে কোনও জিনিস মা নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে দাবিয়ে রেখে দিতে পারত। অবনীও ঘাড় তুলতে সাহস করেনি, কোনও সংশয় প্রকাশ করতে ভরসা পায়নি। বাবার নির্জীবতা সম্পর্কে তার ঘৃণা ধরে গিয়েছিল, এবং কখনও নিজের ভাল মন্দে বাবাকে ডাকেনি, সে অভ্যাস তার হয়নি, মা করতে দেয়নি।
বাবার বিকৃত যৌনাচারে আসক্তি ছিল, এবং অবলম্বন ছিল নেশা। বাবা নানারকম নেশা করত। নেশা এবং নোংরামির জন্যে মা বাবাকে পয়সা দিত। বাবা হাত পেতে নিত। বাবার নিজস্ব কোনও উপার্জন ছিল না। একদা পৈতৃক ধনে বাবা যত না ধনী ছিল, তত অভিজাত ছিল। মা বাবার এই ধন এবং আভিজাত্য নিজের কুক্ষিগত করে। বাবা থিয়েটারের মেয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করার পর মা নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎকে বোকামি করে পায়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি, বুদ্ধিমতীর মতো গ্রহণ করেছিল। পরে অবশ্য মা থিয়েটার ছেড়ে দেয়, কিন্তু মা পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ নষ্ট করেনি। তাদের পরামর্শ যে সব সময় মা নিত তা নয়, তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে মা অর্থের ও আভিজাত্যের সদ্ব্যবহার করত। এই অর্থে তারা প্রতিপালিত হয়েছে। মা চরিত্র-বিলাসী ছিল, জনৈক যুবকের প্রতি মার অনুরাগের বাহুল্যও ছিল। মৃত্যুর আগে বাবা মার ওপর অবিশ্বাস ও আক্রোশবশে একবার মাত্র হঠাৎ নিজের সমস্ত নির্জীবত্ব ভুলে মাথা তুলে দাঁড়াতে গিয়েছিল, পারেনি, বরং এমন আঘাত পেয়েছিল যে বাবা সেই আঘাত সামলাতে পারেনি। বাবা মারা গেল। মা তারপরও আপন জ্যোতিতে জ্বলেছে। শেষ পর্যন্ত মার এই জ্যোতির অকস্মাৎ অবসান ঘটল। মামলায় মকদ্দমায় জড়িয়ে, ব্যর্থতায়, দুশ্চিন্তায় মা মারা যায়; মার তখন নিঃস্ব অবস্থা। অবনী ততদিনে বড় হয়ে গেছে, যুবক; ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াও শেষ করে এনেছে। মার মৃত্যুতে সে দুঃখিত হয়নি, বাবার মৃত্যুর সময় কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছিল, কারণ তখন সে ছেলেমানুষ ছিল, এবং মা সমারোহ করে বাবার সৎকার করিয়েছিল। সমারোহের প্রভাবে বাবার মৃত্যু এত বড় দেখিয়েছিল যে অবনী চোখের জল না ফেলে পারেনি। বাবার শেষ অবস্থায় অবনী প্রায় নিঃসন্দেহে জানতে পারে, মার সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক থাকলেও বাবার সঙ্গে নেই। অবশ্য মা সেই সাজানোবাবার শ্রাদ্ধশান্তি অবনীকে দিয়েই পুরোপুরি করিয়েছিল। ওই বয়সে, কথাটা জানা অথবা সন্দেহ করার পরও অবনীর কিছু করার ছিল না। মার চোখের সামনে সে এত তুচ্ছ ছিল যে তার সাধ্য ছিল না চোখ তুলে মার দিকে তাকায়। কাজেই ইতর-বিশেষ কিছু হয়নি, যেভাবে সে বেড়ে উঠেছিল, মাকে যে অবস্থায় দেখত তাতে সব কিছুই তার গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল।