অবনী অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে কী মনে পড়ায় সিগারেট ধরাল না। হাত বাড়িয়ে গাড়ির সিট থেকে বিজলীবাবুর ফ্লাস্কটা নিল।
কুমকুম সাদা খাতার পাতার আড়াই তিন পাতা চিঠি লিখেছে। বড় বড় হাতের লেখা, পেনসিলে লিখেছে, হাতের লেখা কাঁচা, অপরিষ্কার। তাড়াতাড়িতে লেখার জন্যেই হোক, কিংবা লুকিয়ে লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে লেখার জন্যই হোক, লেখা খুব খারাপ হয়েছে, ভুলও হয়েছে অনেক। হয়তো মেয়েটা শরীরেও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বাবা, আমার টাইফয়েড হয়েছিল। একশো পাঁচ জ্বর হয়েছিল। …বাবা, আমার খুব খিদে পায়, মা দুটো কমলালেবু দেয়। খুব টক। ..পুজোর জামাটা বিচ্ছিরি হয়েছে। আমার ভাল ফ্রক নেই, জুতো নেই। …বাবা, মাসি আমায় বলেছে, আমি মরে যাব। …আমার ভাল ফ্রক, জুতো কিনে পাঠিয়ে দিয়ো। ক্যাডবেরি দিয়ো। বাবা, আমি দুটো ক্লিপ পেয়েছি, জগুদা দিয়েছে। তুমি আমায় দেখতে আসবো…
অবনী অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল। জ্বর আসার মতন তার শরীরে কেমন শীত ধরছিল, চোখ জ্বালা করছে, কোনও কিছু দেখছিল না। ক্রমশ তার চোয়ালে চাপ লাগছিল। দাঁত যেন কিছু কামড়ে ধরতে চাইছিল। হিংস্রভাবে অবনী কী যেন একটা বলল।
তারপর হঠাৎ সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েক পলক তার শূন্য দৃষ্টির মধ্যে কোনও কিছুই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল না, পরে চোখ সামান্য পরিষ্কার হলে দেখতে পেল সামনে মালিনী। মালিনী কেমন সকুণ্ঠ এবং বিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অবনী হৈমন্তীর ঘরের বারান্দার সামনে।
মালিনী আস্তে করে বলল, হেমদি কলকাতায় গেছেন, এখনও ফেরেননি।
অবনী কথা বলল না, মালিনীকে দেখতে লাগল। বারান্দার নীচে মালিনী দাঁড়িয়ে, নির্মল জ্যোৎস্নায় তার মিলের সাদা শাড়ি, গায়ের ময়লা রং, গোলগাল সাধারণ চেহারা, টলটলে মুখ কেমন নতুন দেখাচ্ছিল।
অবনী অস্পষ্টভাবে কিছু বলতে গেল, গলায় স্বর ফুটল না।
.
১২.
কুমকুমের চিঠি পাবার পর অবনী বিরক্ত, ক্ষুব্ধ ও অপ্রসন্ন হয়েছিল। মেয়ের ওপর যতটুকু বিরক্ত হয়েছিল তার শতগুণ বেশি ললিতার ওপর। অবনী যা ফেলে এসেছে, যার সঙ্গে ওর আর কোনও সম্পর্ক নেই, যার সবটাই তিক্ত, কুমকুমের চিঠি আবার তা জোর করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। কুমকুম তাকে পুরনো তিক্ততার মধ্যে টেনে নিয়ে যাক অবনীর তা পছন্দ হয়নি। মেয়ের ওপর এক চাপা অভিমানও তার ছিল। মার দেখাদেখি এবং মার শিক্ষায় সে বাবাকে অনাত্মীয় ভাবতে শিখেছিল, ললিতার মুখে শুনে শুনে চার বছরের মেয়েও এক সময়ে তাকে পাজি বজ্জাত বলেছে। তার মুখের অর্ধেক কথা তখনও স্পষ্ট হয়নি। আরও কত কী বলত। আজ সেই মেয়ের হঠাৎ বাবার ওপর টান উথলে উঠল কেন?
কুমকুমের ওপর এই বিরক্তিটা অবশ্য সাময়িক, অবনী যথাসময়ে ভুলে যেতে পারল। ভুলতে পারল না ললিতাকে। চিঠিটা অহরহ তাকে খোঁচা দিচ্ছিল, এবং ললিতার ওপর ঘৃণা ও আক্রোশ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। ললিতার সুখ-সুবিধে ফুর্তির জন্যে সে মাসে মাসে অতগুলো করে টাকা পাঠায় না। মেয়েকে ললিতা উপযুক্তভাবে প্রতিপালন করবে এটা তাদের শর্ত ছিল। ললিতা মেয়েকে অবনীর কাছে দিতে পারত, দেয়নি স্বার্থের জন্যে। তার ভয় ছিল, অবনী মেয়ে পেয়ে গেলে, যে-কোনও সময়ে ললিতাকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিতে পারে; বা সে ভেবেছিল, অবনী যা পাঠাবে তা এত সামান্য যে ললিতার নামমাত্র ভরণ-পোষণ হতে পারে। মেয়েকে নিজের অধিকারে রেখে ললিতা আর্থিক উদ্বেগের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল মাত্র, যেন কুমকুমকে সে জামিন হিসেবে রেখে নিয়েছিল।
অবনী প্রাথমিক উত্তেজনায় ললিতাকেই চিঠি লিখতে গিয়েছিল। পরে মনে হল, ললিতাকে চিঠি লেখাটা বোকামি হবে, কুমকুম লুকিয়ে বাবাকে চিঠি লিখেছে এটা জেনে ললিতা মেয়ের ওপর প্রসন্ন হবে না। কুমকুমকে সরাসরি চিঠি লেখা বা কিছু টাকা পাঠানোও উচিত নয়, ললিতা জানতে পারবে, কুমকুম ধরা পড়ে যাবে। ললিতা এখন তার বাবার কাছে থাকে, সেখানে তার বাবা, ভাই বোন এদের দৃষ্টি এড়িয়ে কুমকুমকে কিছু করা যাবে না–একটা চিঠি লেখাও অসম্ভব। ললিতা মেয়ের ওপর আক্রোশবশে যে-কোনও রকম নির্যাতন করতে পারে, তার পক্ষে সবই সম্ভব।
অনেক ভেবে অবনীর মনে হয়েছিল, কমলেশকে একটা চিঠি লেখাই সবচেয়ে ভাল। কিংবা ধ্রুবকে। ধ্রুব কোনওদিনই ললিতাকে পছন্দ করেনি। তার স্বভাবটাও গোঁয়ারের মতন। ললিতাদের বাড়ি গিয়ে একটা গণ্ডগোল বাধাতে পারে, তাতে লাভ হবে না। তার চেয়ে কমলেশকে লেখাই ভাল। কমলেশের সঙ্গে ললিতার পরিচয় পুরনো, অবনীর সঙ্গে ললিতার পরিচয় করিয়ে দেবার আগেও ললিতাদের বাড়িতে তার আসা-যাওয়া ছিল। কমলেশের স্বভাব ঠাণ্ডা, ভেবেচিন্তে গুছিয়ে কাজ করতেও পারে। তা ছাড়া কলকাতার বন্ধুদের সঙ্গে অবশিষ্ট যেটুকু সম্পর্ক তা এখনও কমলেশের সঙ্গেই আছে। মাঝে মাঝে কমলেশের চিঠি পাওয়া যায়। ধ্রুবর সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগও আর নেই।
কমলেশকেই চিঠি লিখেছিল অবনী। লিখেছিল, কমলেশ যেন একবার ললিতাদের বাড়ি যায়, ললিতা এবং কুমকুমের সঙ্গে দেখা করে; দেখা করে আড়ালে কুমকুমকে বলতে বলেছিল যে, অবনী তার চিঠি পেয়েছে, কিন্তু চিঠি লিখলে পাছে তার মা-মাসিমা জানতে পারে তাই লিখল না। কুমকুম যেন তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে, মন খারাপ না করে। কমলেশকে কুমকুমের জন্যে দু-চারটে ভাল জামা কিনে নিয়ে যেতেও লিখেছিল অবনী, জামা, টফি, জুতো। অবনী বিশেষ করে সাবধান করে দিয়েছিল, ললিতা যেন কুমকুমের চিঠি লেখার কথা জানতে না পারে। কমলেশকে একথাও অবনী খোলাখুলি লিখেছিল যে, ললিতা যদি মেয়ের প্রতি যত্ন না নেয়, তবে সে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়ে ললিতাকে শিক্ষা দেবে। আর কুমকুম? দরকার হলে কুমকুমকে কোনও হোস্টেলে রেখে দেবে অবনী।