বিজলীবাবু যেন নিশ্বাস বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকলেন। অবনীর চরিত্রটি যেন তিনি দেখবার বা বোঝবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু ঈষৎ আলে পর অন্ধকার যেমন দৃষ্টিকে দিশেহারা করে তেমনি তিনি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলেন।
ব্যাপারটা পুরনো, আমার আর কোনও ইন্টারেস্ট নেই, অবনী গলা পরিষ্কার করতে করতে বলল। টাকাটা পাঠাতে হয় পাঠাই।
চিঠিটা কার? বিজলীবাবু শুধোলেন।
অবনী নীরব। তার সামনে, পাশে হেমন্তের সাদাটে জ্যোৎস্না; গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া শব্দ নেই, মাঠ-ঘাট জুড়ে বুঝি ঝিঁঝি ডাকছে, কানে হঠাৎ এই শব্দটা লাগল। অল্প দূরে আশ্রম, ছায়ার মতন দেখাচ্ছে।
অবনী মৃদু গলায় বলল, আমার মেয়ের।
বিজলীবাবু চমকে উঠলেন, স্ত্রীর কথা শুনে এতটা চমকাননি। আপনার মেয়ে?
অবনী আর কোনও কথা বলল না।
.
বিজলীবাবুর হাঁকডাকের আগেই সুরেশ্বর বেরিয়ে এসেছিল। আরে, আসুন–আসুন! কী সৌভাগ্য।
সৌভাগ্য তো আমাদের মশাই, আপনারা হলেন মহম্মদ, আমরা হলাম পর্বত। আপনি নড়লেন না, তাই আমরা এলাম। বিজলীবাবু সরল রসিকতা করে বললেন, আসুন কোলাকুলিটা সেরে নিই আগে।
কোলাকুলি সারা হল। অবনী হঠাৎ কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে, অন্যমনস্ক, তেমন কোনও কথাবার্তাও বলল না। বিজলীবাবু টিফিন কেরিয়ারটা সুরেশ্বরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আরও পাঁচটা হাসিঠাট্টা করলেন।
সুরেশ্বরের বাড়ির ছোট বারান্দাটুকুতেই বসল ওরা। সুরেশ্বর ভরতুকে ডাকতে চলে গিয়েছিল, ফিরে এসে বসল।
পায়ের ব্যথার জন্যে নয়, অন্য কারণে সুরেশ্বর যেতে পারেনি। গোড়ালির ব্যথাটা দু-একদিনের মধ্যেই সেরে গিয়েছিল, কিন্তু অষ্টমীর দিন শেষ রাতে অন্ধকুটিরের এক-পাশের অনেকখানি চাল হঠাৎ কেমন করে যেন ধসে গেল। না, জখম-টখম হয়নি কেউ। পরের দিন ওপাশের সমস্ত খাপরা সরিয়ে, নতুন করে চাল বেঁধে খাপরা-টাপরা বসিয়ে তবে স্বস্তি। দুটো দিন এই সব করতেই কাটল। বোধহয় বর্ষার মধ্যে, এবং সেদিন ওই রকম ঝড় বৃষ্টিতে চালের কাঠকুটোয় কিছু হয়েছিল, ঘুণ ধরেছিল আগেই, ভেঙে পড়ল আচমকা। তা ছাড়া আশ্রমে দেখাশোনা করার লোকজনও কেউ ছিল না তেমন। পুজোয় মালিনী বাড়ি গিয়েছিল কাল সকালে ফিরেছে, হৈমন্তী কলকাতায়, এখনও ফেরেনি, চিঠি দিয়েছে। পূর্ণিমার পরের দিন ফিরবে, যুগলবাবু গিয়েছিলেন গয়া, ফিরেছেন কাল, শিবনন্দজি নিয়মিত আসতেন, তাঁর চেষ্টাতেই লোকজন মালপত্র জোগাড় করে রাতারাতি সব মেরামত করানো গেল। গতকাল সুরেশ্বর অন্ধ আশ্রমের অন্ধজনদের নিয়ে গিয়েছিল বিশাইয়া, দশারার মেলায়।
অবনী মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনছিল না; কানে আসছিল, কিছু খেয়াল করছিল কিছু করছিল না। ভরতু চা দিয়ে গেল, বিজলীবাবুর আনা মিষ্টি থেকে কিছু মিষ্টি, কয়েকটা পেঁড়া। বিজলীবাবু প্রতিবাদ করছিলেন–করছেন কী, আপনার ভাগ আমরা লুটেপুটে খাচ্ছি জানলে বড় বউ খেপে যাবে, মশাই…; সুরেশ্বর শুনেও শুনল না যেন।
কিছুক্ষণ বসে থাকল অবনী। সুরেশ্বর আর বিজলীবাবুর মধ্যেই গল্পগুজব হচ্ছে, দু-একটা কথা কখনও বলছিল অবনী, পর পর কয়েকটা সিগারেট খেয়ে মুখ বিস্বাদ লাগছে। ভাল লাগছিল না বসে থাকতে। এক সময় সে উঠে পড়ল, বলল, আপনারা গল্পগুজব করুন, আমি মাঠে একটু পায়চারি করি, মাথাটা ধরা ধরা লাগছে।
উঠে এসে মাঠে দাঁড়াল অবনী। আকাশের দিকে মুখ তুলে হাঁ করে নিশ্বাস নিল বার কয়েক। দ্বাদশীর চাঁদ অনেকখানি ভরে এসেছে, একপাশে এক টুকরো মেঘ, ঘেঁড়াখোঁড়া, নিচু দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। অবনী আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল।
বিজলীবাবু ধূর্ত নন, তার পেছনে গোয়েন্দাগিরিও করেননি, তবু তিনি ললিতা আর কুমকুমের কথা জেনেছেন। ললিতার কথা লুকোবার চেষ্টা অবনী কি সত্যি সত্যিই তেমন কিছু করেছিল? না, করেনি। প্রতি মাসে ললিতার নামে মানিঅর্ডারের টাকা যায়, রসিদ ফিরে আসে। অফিসের চাকর, পোস্ট অফিসের কেরানি, রামেশ্বর পিয়ন এদের কাছে অন্তত মানিঅর্ডারের কথাটা জানা, উৎসাহ প্রকাশ করলে যে-কোনও লোকই এটা জানতে পারত। কিন্তু লুকোবার চেষ্টা না করেও অবনী ললিতার প্রসঙ্গটা কখনও কারও কাছে উল্লেখ করেনি। করার ইচ্ছে হত না, কারণও ছিল না। বিজলীবাবু হয়তো ভাবছেন, অবনী চালাকি করে নিজের স্ত্রীর কথা গোপন করেছে। তা কিন্তু নয়, অবনী ভাবছিল, সে ঠিক গোপন করার মন নিয়ে কিছু করেনি, যার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই, থাকবে না, যার প্রসঙ্গ বলা অথবা না বলায় কিছু আসে যায় না–অবনী সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করবে কেন! কোনও কারণ ছিল না করার। কথাটা আগে জানলেই বা কী লাভ হত বিজলীবাবুর! কৌতূহল নিবৃত্ত হত মাত্র, কিংবা আরও বাড়ত, তার বেশি কিছুনয়। ব্যক্তিগত ব্যাপার, বিশেষ করে যা তিক্ত স্মৃতি, যার সঙ্গে অবনীর জীবনের কোথাও কোনও সম্পর্ক নেই আর, তা বলার উৎসাহ তার হয়নি।
অবনী হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে চলে এসেছিল। দাঁড়াল।
ললিতার জন্যে নয়, কুমকুমের জন্যেই অবনীর ভাল লাগছিল না। কুমকুম আগে কখনও চিঠি লেখেনি, এই প্রথম। সে, খুব সম্ভব, লুকিয়ে অবনীর ঠিকানা কোথাও দেখেছে। ঠিকানা দেখে চিঠি লিখেছে। ছেলেমানুষ বলেই, টাইফয়েডের পর, দুর্বল অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে তার বাবার কথা মনে পড়েছে। বোধহয় ললিতা মেয়ের ওপর তেমন যত্ন নেয় না এবং পুরো টাকাটা নিজের সুখ-সুবিধের জন্যে ব্যয় করছে। কুমকুমের চিঠি থেকে মনে হয়, মার ওপর ভীষণ অভিমান করে এবং নিজের চার পাশে একান্তভাবে তার নিজের কাউকে না দেখে মেয়েটার মনে খুব লেগেছে। নয়তো কুমকুম চিঠি লিখত না। ললিতা মেয়েকে কখনওই এমন কিছু শেখায়নি যাতে বাবার ওপর তার মন টানে। আগাগোড়া ললিতা মেয়েকে বাবার ওপর অশ্রদ্ধা প্রকাশ করতে শিখিয়েছিল, ঘৃণার শিক্ষাটা মেয়েকে সে দিয়েছিল, যেন অবনী পাশের বাড়ির বা পাড়ার কোনও একটা শয়তান গোছর মানুষ। কুমকুমের স্বভাব নোংরা, ইতর হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সেই মেয়ে আজ বাবাকে ওভাবে চিঠি লিখল কেন?