লোকটিকে আপনি পছন্দ করেন।
পছন্দ! ..তা করি। …ব্যাপারটা কী জানেন মিত্তিরসাহেব, আমি তত বেশি কিছু বুঝি না, মুখ মানুষ, কিন্তু একটা জিনিস বেশ বুঝি। সংসারে আমরা আমাদের মতন মানুষ যারা–তারা যে যার নিজের তল্পি নিয়ে আছি। নিজের ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আমাদের চোখ বুজতে হয়। সুরেশ মহারাজার-টহারাজের মতন লোক তবু দুটো কাজ করেন। আমরা কিছুই করি না।
অবনী শুনল। সামনে একটা ঢাল, গিয়ার বদলে নিল গাড়ির। হেসে বলল, এ-সব লোক সম্পর্কে আপনার ওমর খৈয়াম কী বলেন?
বিজলীবাবু সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলেন না, পরে বললেন, জানি না মিত্তিরসাহেব, তবে আমার মনে হয় ওঁরা হলেন অন্য ধরনের মানুষ–কেউ তো তারা ছোঁয় না সুরা, যেমন তেমন লোকের সাথে; সুযোগ পেলেই সব আসরে, পাত্র তাঁরা নেন না হাতে।
সামান্য চুপ থেকে অবনী পরিহাস করে বলল, তা আমাদের সঙ্গে পাত্র না নিন, পাত্র তো হাতে তুলে ধরেন। কোন আসরে ধরেন?
সে ওঁদের আলাদা আসর– বিজলীবাবুও হেসে বললেন, তবে পাত্র ওঁরা ধরেন। নেশায় না ডুবলে কেউ কাজ করতে পারে না, মিত্তিরসাহেব। মাতাল হতে হয়, সাধারণ জ্ঞানগম্যি নয়তো হারানো যায় না।
অবনী চুপ। আর অল্প মাত্র পথ, লাইটার মোড় এসে গেছে।
লাঠটার মোড় পৌঁছে গাড়ি ঘুরিয়ে গুরুডিয়ার কাঁচা পথ ধরল অবনী।
বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেব, আমার তেমন কোনও সিকরেট নেই। যা বুঝি বলে ফেললাম।
অবনী জবাব দিল না। কোথায় যেন তার সামান্য ঈর্ষার মতন লাগছিল, অধম মনে হচ্ছিল নিজেকে। বিজলীবাবুর সঙ্গে তার পরিচয় বা ঘনিষ্ঠতা কম নয়, দিনে দিনে সেটা বাড়ছিল, বিজলীবাবু হয়তো এই ঘনিষ্ঠতাকে সাধারণ পর্যায়ের মনে করেন। অবনী সম্পর্কে তাঁর কোনও শ্রদ্ধা নেই, অনুরাগও হয়তো নেই। অবনীর মনে হল, তার চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে বিজলীবাবুর যে ধারণা তা সম্ভবত মদ্যপানের সঙ্গী হিসেবেই যতটুকু হতে পারে ততটা তার বেশি কিছু নয়।
সুরেশ্বরের সঙ্গে নিজেকে এভাবে তুলনা করেও তার বিরক্তি লাগছিল। বিজলীবাবু তাকে উত্তম অথবা অধম যাই ভাবুন না কেন কী আসে যায়! চিন্তাটা মন থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করল অবনী, এবং ঈষৎ অপ্রসন্নতা সত্ত্বেও তা প্রকাশ করল না। বরং যথাসম্ভব হালকা গলায় বলল, আপনার সিকরেট নেই বলছেন, কিন্তু একে একে এই সব সিকরেট যে বেরিয়ে পড়ছে, বিজলীবাবু!
বিজলীবাবু বোধহয় লজ্জিত হলেন, মাথা নেড়ে বললেন, না না, এ আর এমনকী সিকরেট।
গুরুডিয়ার কাঁচা রাস্তায় গাড়িটা মাঝে মাঝে লাফিয়ে উঠছিল। বিজলীবাবু পিছনের সিটের দিকে তাকিয়ে টিফিন কেরিয়ারটা দেখলেন, কাত হয়ে পড়ে গেছে, জিবের একটা শব্দ করে হাত বাড়িয়ে টিফিন কেরিয়ারটা সামনে নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। সুরেশ-মহারাজা পুজোর মধ্যে আসব বলেও আসেননি। কী হল কে জানে। হয়তো পায়ের ব্যথা বেড়েছে। পুজোমণ্ডপে মালিনীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিজলীবাবুর, সে সপ্তমীর দিন সকালে বাড়ি এসেছে, সুরেশ-মহারাজের কথা বলতে পারল না। অপেক্ষায় থেকে থেকে আজ তাঁরা যাচ্ছেন, বিজয়ার দেখা সাক্ষাৎ সেরে আসবেন। বড় বউ কিছু মিষ্টি-টিষ্টি দিয়ে দিয়েছে।
গুরুডিয়ার এই কাঁচা রাস্তায় নেমে দ্বাদশীর জ্যোৎস্না আরও পরিচ্ছন্ন করে দেখা যাচ্ছিল। আদিগন্ত মাঠে নিঃসাড়ে যেন জ্যোৎস্নার স্রোত ভাসছে, হেমন্তের খুব হালকা একটু হিমের অস্পষ্টতা আছে কোথাও, শীতের সামান্য আমেজ লাগছে, চারদিক নিস্তব্ধ; মাঠে পলাশ আর আমলকি ঝোপে জোনাকি জ্বলছে।
বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেব, একটা কথা তা হলে বলি। আমার সিকরেট আর জানলার পরদা একই জিনিস; বাতাস দিলেই উড়ে যায়, দেখতে কষ্ট হয় না। কিন্তু আপনি হলেন মিস্টিরিয়াস ম্যান। …কদিন ধরেই আপনাকে জিজ্ঞেস করব ভাবছি, কেমন লজ্জা লজ্জা করছে। ..সেদিন আপনাকে জিজ্ঞেস করছিলাম না, একটা চিঠি পেয়েছেন কি না–ঠিকানা পড়া যায় না। আপনি বললেন পেয়েছি।
অবনী মুখ ফিরিয়ে বিজলীবাবুকে দেখল।
বিজলীবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ললিতা মিত্র কে?
অবনী অসতর্ক হয়ে ব্রেক টিপতে যাচ্ছিল, গাড়িটা কেমন ঝাঁকুনি খেল সামান্য, আবার চলতে লাগল।
চুপচাপ। অবনী কোনও জবাব দিচ্ছে না, বিজলীবাবু অপেক্ষা করে আছেন। আড়ষ্ট সময় পলে পলে বয়ে যাচ্ছে।
কিছু সময় পরে অবনী বলল, আপনি জানলেন কী করে?
মানি অর্ডারের রসিদ দেখলাম।
ও।
পোস্ট অফিসে গিয়েছিলাম সুরেশ-মহারাজের সঙ্গে; রামেশ্বর আমায় চিঠিটা দেখাচ্ছিল, তখনই রসিদটা দেখলাম।
অবনী গাড়ি থামিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর হাসবার চেষ্টা করে বলল, আপনার সুরেশ-মহারাজও কি জানেন নাকি?
না, তিনি পোস্ট অফিসের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলেন।
গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল। সামান্য এগিয়ে অবনী বলল, ললিতা এক সময়ে আমার স্ত্রী ছিল।
এক সময়ে?
বছর কয়েক।
বিজলীবাবু বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বোধহয় বুঝতে পারছিলেন না, এক সময়ে যে স্ত্রী থাকে পরে সে কী হয়। বিব্রত গলায় শুধোলেন, এখন তিনি আপনার স্ত্রী নন?
না।
কী রকম? তাঁকে টাকা পাঠাচ্ছেন…
ওটা একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট। খোরপোষ দিচ্ছি।
ও! আপনি স্ত্রী ত্যাগ করেছেন?
দুজনেই দুজনকে করেছি; পরে একটা ডিভোর্স নিয়ে নেব।