জিপগাড়িতে স্টার্ট দিল অবনী। ঠাট্টা করে বলল, একজনকে না হয় লুকোলেন, অন্যজন? তিনি কী বললেন?
তিনিও খুশি নন। বললাম, এক পোয়া জিনিসের সঙ্গে পাঁচ পো জল মিশিয়েছি গো, এই খেয়ে নেশা হবে না; কোনও ভয় নেই–অপঘাতে মরব না।
অবনী হাসতে লাগল। গাড়ি চলতে শুরু করেছিল।
বিজলীবাবু পান চিবোচ্ছিলেন। অবনীর আজ অন্য পোশাক। ধুতি পাঞ্জাবি। দশমীর দিন ভেঙেছিল। পাঞ্জাবি পাজামা অবশ্য বাড়িতে পরে, ধুতি আর পরা হয়ে ওঠে না। কলকাতায় থাকতে তবু মাঝে মাঝে পরা হত, এখানে এসে একেবারেই হয় না। নিতান্ত বিজয়ার দিন লোকজন আসে বাড়িতে, দু-এক জায়গায় তাকেও যেতে হয় তাই এই ধুতি।
ম্যালেরিয়া কনট্রোলের অফিস পেরিয়ে গাড়ি টাউনের রাস্তা ধরল। বিজলীবাবু সিগারেট বের করলেন, আসুন, মিত্তিরসাহেব।
পরে; আপনি নিন।
বিজলীবাবু সিগারেট ধরিয়ে নিলেন।
বাড়ি প্রায় শেষ হয়ে এল, মাঠের কোলে সন্ধের আবছা ভাবটা গাঢ় হয়ে এসেছে। তারই গায়ে গায়ে জ্যোৎস্না ধরছে। শুকনো ঠাণ্ডা বাতাস, দুপাশে গাছের মাথায় এখনও পাখির ঝাঁক উড়ে উড়ে বসছিল, কলরব ভাসছে। বিজলীবাবু পিছনের সিটের দিকে তাকিয়ে টিফিন কেরিয়ারটা ঠিক করতে লাগলেন। গাড়ির ঝাঁকুনিতে নড়ছিল, উলটে যেতে পারে।
অবনী বলল, আপনার স্ত্রী সুরেশমহারাজের খুব ভক্ত, না বিজলীবাবু?
তা খাতির-টাতির করে বই কি! মেয়েদের দুটো রোগ আকচার থাকে, মিত্তির সাহেব; এক, হিস্টিরিয়া আর দুই হল গিয়ে ওই আইবুড়ো সাধু-সন্নেসী মহারাজ-টহারাজের ওপর ভক্তি।
অবনী হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, টিফিন কেরিয়ার দেখে তাই মনে হচ্ছে।
বিজলীবাবু জবাব দিলেন, এ যা দেখছেন সমস্তই আমার বড় গিন্নির। ছোটও দলে আছে, তবে অতটা নয়। …বুঝলেন মিত্তিরসাহেব, সুরেশ-মহারাজ যখন এদিকে থাকতেন তখন মাঝে মধ্যে আমার বাড়িতে আসতেন, এক-আধদিন তুলসী রামায়ণও গেয়ে শুনিয়েছেন অল্পস্বল্প। বড় গিন্নির তখন থেকেই সুরেশ-মহারাজের ওপর একটু টান।
আপনার নিজেরও বেশ টান…।
আমার! ..আমার কী টান থাকবে। উনি হলেন নিরামিষ মানুষ, আমরা হলুম আমিষ ব্যক্তি। চরিত্তই আলাদা। বিজলীবাবু হেসে হেসে বললেন।
অবনী গাড়ি চালাতে চালাতে ঘাড় বেঁকিয়ে বিজলীবাবুকে একবার দেখল। তারপর বলল, আপনি সুরেশ-মহারাজকে পাঁচশো টাকা দিয়েছিলেন?
বিজলীবাবু যেন হঠাৎ কেমন হয়ে গেলেন, চোখের পাতা পড়ল না, মুখ ফিরিয়ে অবনীকে বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখছিলেন।
শেষে বললেন, কে বলল?
আপনার সুরেশ-মহারাজ।
বিজলীবাবু যেন সামান্য বিব্রত এবং অপ্রস্তুত বোধ করছিলেন। কথাটা স্বীকার করতে তাঁর অদ্ভুত কুণ্ঠা জাগছিল। সরাসরি কোনও জবাব না দিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, কবে বললেন?
বলছিলেন একদিন কথায় কথায়।
কথাটা ঠিক নয়– বিজলীবাবু জবাব দিলেন, তারপর সামান্য চুপচাপ থেকে যেন অবনীকে বোঝাচ্ছেন এইভাবে বললেন, টাকাটা আমি ঠিক দিইনি, আর পাঁচশো টাকা আমি পাবই বা কোথায়, গরিব মানুষ। উনি ভুল বলেছেন।
ভুল অবনী কৌতুক করে বলল।
বিজলীবাবু যেন রীতিমতো অকুলে পড়ে গেছেন। বললেন, ব্যাপারটা কী জানেন মিত্তিরসাহেব, একবার সুরেশ-মহারাজ যখন আশ্রমের কাজে হাত দিয়েছেন তখন তাঁর হঠাৎ একদিন টাকার খুব দরকার হয়ে পড়ে। দেশের দিকে বোধহয় ওঁর কিছু সম্পত্তিটম্পত্তি বেচা-কেনার কথা চলছিল, টাকাটা সময় মতন পাননি। এখানে এসেছিলেন টাকা হাওলাত করতে। আমার সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছিল, আমাকে বলেছিলেন কোনও মাড়োয়াড়ি মহাজনের কাছে নিয়ে যেতে। তা আমি দেখলাম, মাড়োয়ারি মহাজনের কাছে টাকা হাওলাত করাটা ওঁর পক্ষে ভাল দেখায় না। তা ছাড়া আমি থাকব সঙ্গে, মাড়োয়ারিগুলোই বা বলবে কী। ভাববে আমি বাঙালি হয়েও নিজের মুলুকের আদমি-কে পাঁচশোটা টাকা জোগাড় করে দিতে পারলাম না। ইজ্জতে লাগল…। তা ছাড়া এখানকার মাড়োয়ারিদের সঙ্গে আমার এমনি যে খুব দহরম-মহরম, সে মুখে, ভেতরে ভেতরে রেষারেষি। সে অনেক পুরনো ব্যাপার মিত্তিরসাহেব, বাস-টাস, বাজারের বাড়ি-নানারকম ব্যাপার আছে। …তা আমি পড়ে গেলাম প্যাঁচে। কী করি! তখন আমি সুরেশ-মহারাজকে তিনশো টাকা ধার দি৷ আর বাকি দুশো টাকা দিয়েছিল আমার বড় পরিবার। আমার মুখে শুনেছিল, শুনে দিয়েছিল। ওটা তার ব্যাপার।
অবনী কোনও কথা বলল না। উলটো দিক থেকে একটা লরি আসছে বোধহয়, এত জোরালো আলো যে অবনীর চোখে লাগছিল, নিজের গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে সরিয়ে নিল।
বিজলীবাবু নিজের থেকেই বললেন, সুরেশ-মহারাজ কিন্তু তার পরই টাকাটা শোধ করে দিতে চেয়েছিলেন, হাতে টাকা এসে গিয়েছিল। তা আমি তখন টাকাটা নিইনি। বলেছিলাম, এখন থাক; পরে দরকার পড়লে নেব। …তারপরও উনি অনেকবার বলেছেন, আমি নিইনি। এক সময় নিলেই হবে।
লরিটা একেবারে সামনাসামনি, অবনী সাবধানে পাশ কাটিয়ে নিল। সামনে ফাঁকা রাস্তা, দুপাশে ক্ষেতি, দ্বাদশীর চাঁদের আলো বেশ ফুটতে শুরু করেছে।
অবনী এবার একটা সিগারেট ধরাল। বলল, আপনি যতই বলুন, সুরেশ-মহারাজের ওপর আপনার বেশ টান আছে। হেসে হেসেই বলল।
বিজলীবাবুও হেসে বললেন, টান বলবেন না, বলুন খাতির। তা মহারাজ মানুষ, একটু খাতির যত্ন করলে চলে! ..আমার সঙ্গে ওঁর দেখাসাক্ষাতই বা আজকাল কতটুকু হয় যে মেলামেশা থাকবে।