ললিতার সঙ্গে আলাপ সাধারণ ভাবেই। কমলেশ আলাপ করিয়ে দিয়েছিল রাস্তায়। একসময় কমলেশ অবনীর সহপাঠী বন্ধু ছিল। মাঝে মাঝে অবনীর কাছে আড্ডা মারতে গল্প-সল্প করতে আসত। কমলেশ হাসিখুশি মেজাজের ছেলে, চাকরি করত মোটামুটি ভাল জায়গায়, চৌরঙ্গি পাড়ায় কোনও কোনওদিন বিয়ার-টিয়ার খেতে আসত। একদিন অবনীর সঙ্গে লিন্ডসে স্ট্রিটের কাছে দেখা কমলেশের, সঙ্গে ললিতা। পরিচয় করিয়ে দিল কমলেশ।
অবনী প্রথম দর্শনেই আকৃষ্ট হয়েছিল। ললিতার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা যে-কোনও পুরুষের পক্ষেই স্বাভাবিক ছিল। দেহজ সৌন্দর্য প্রথমেই পুরুষের চোখকে নিষ্পলক ও কাতর করে– ললিতার শরীরে সে সৌন্দর্য অতিমাত্রায় ছিল। প্রখর ও প্রলুব্ধক সেই রূপে অনী আকৃষ্ট হল। ললিতার মুখ ছিল ভাসন্ত, সামান্য হোট:কপাল চওড়া, গালের চামড়া পাতলা, ফোলানাক একটু মোটা, ঠোঁট পুরু। ঠোঁটের ডগায় ডিমের কুসুমের মতন টলটলে, আঠালো ভাব ছিল। ললিতার চোখ ছিল বড় বড়; ঘন, মোটা ভুরু, পাতা মোটা। দৃষ্টিতে কটাক্ষ ও কামভাব ছিল। ওর মুখ চোখের মধ্যে কোথাও এক ধরনের মাদকতা থাকায় ললিতা চোখ জড়িয়ে বিলোল করে কথাবার্তা বলত, বাদামের দানার মতন দাঁত দেখিয়ে হাসত। ওর কাঁধ, গলা সুন্দর ছিল; পিঠ ভরা; স্তন পরিপূর্ণ ও দৃঢ়; গুরু নিতম্ব, সুডৌল জঙ্ঘা।
অবনী প্রথম দর্শনেই ললিতাকে তার চিত্ত চঞ্চলতা বুঝতে দিয়েছিল। ললিতাও বুঝেছিল।
পরিচয় খুব সামান্য সময়ের মধ্যেই ঘনিষ্ঠতায় দাঁড়াল। অনী সেসময় যেরকম ব্যবহার করেছিল তাতে মনে হবে, তার মন ও দৃষ্টিকে সে একই জায়গায় নিবদ্ধ রেখেছিল। একটি মাত্র বস্তু কামনা করলে যেভাবে মানুষ অন্য আর সব কিছু ভুলে যায়–অবনী সেই ভাবে অন্য কোনও বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ না করে একমাত্র ললিতাতেই তার মনঃসংযোগ করেছিল।
কমলেশ একদিন বলল: কীরে, তুই যে একেবারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিস।
জ্ঞান হারাবার মতনই দেখাচ্ছিল তখন। অবনীকে একমাত্র অফিসে ছাড়া কোথাও কখনও বড় একা দেখা যেত না। সে সর্বদাই ললিতাকে সঙ্গে রাখত, বা ললিতাকে সঙ্গদান করত। কমলেশ ঠাট্টা করে যাই বলুক, অবনী দিশেহারা অথবা উন্মাদ হয়নি, সে ললিতাকে একটি কলয়ের মতন চতুর্দিক থেকে আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলেছিল। চতুরের মতন সে এ কাজ করেনি, আবেগ ও বাসনার দ্বারা করেছিল। ললিতার প্রতি তার আকর্ষণ অতি তীব্র ও আন্তরিক হওয়ায় সে সতর্ক, সংযত হয়নি, হবার চেষ্টাও করেনি। প্রয়োজন ছিল না। কমলেশ পরে আবার একদিন বলল:
একটু সাবধান হ
কেন?
আমি যতদূর জানি, ওর আরও কিছু বন্ধুবান্ধব আছে।
তাতে আমার কী?
অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।
এক সন্ন্যাসীর গাজনটাই তুই দেখ, বাদবাকির কথা ভাবিস না।
তুই ভীষণ সিরিয়াস। প্রেমে পড়েছিস নাকি!
ওসব প্রেমটেম বুঝি না, ভাই; ভাল লাগে, দ্যাটস অল।
বিয়ে করবি?
লোকে তো তাই করে।
ললিতার সঙ্গে পরিচয়ের বছর দেড়েকের মধ্যেই অবনী তাকে বিয়ে করে ফেলল। ললিতা ভাল করে কিছু হুঁশ করতে পেরেছিল কি না কে জানে। অবনী সে সুযোগ সম্ভবত দেয়নি। যদি এমন ধরে নেওয়া হয় যে, ললিতা অবনীর মৃগয়ার বস্তু ছিল তবে অবনী তার শিকারকে দ্বিধা করতে, সরে যেতে অথবা পালিয়ে যেতে দেয়নি; নিশানার বিন্দুমাত্র ভুলচুক না করে স্থির দৃষ্টি রেখে সে লক্ষ্যভেদ করেছিল। অবনীর এই সাফল্যের মূলে তার বাসনার তীব্রতা ছিল সবচেয়ে বেশি, তার অনমনীয় দৃঢ় পৌরুষ, তার দ্বিধাহীন আকাঙ্ক্ষা এবং স্পর্ধিত আক্রমণের সামনে ললিতা অসহায় হয়ে পড়েছিল।
ললিতা বোকা বা অনভিজ্ঞ ছিল এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। নিজের দাম সে জানত। সাংসারিক লাভ লোকসানের হিসেবটা সে মনে মনে ভালভাবেই কষে রেখেছিল। ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও তার মোটামুটি একটা ধারণা ছিল। কিন্তু ললিতা কোনও কোনও জায়গায় তার হিসেবের ভুল করে ফেলেছিল। অবনীকে সে যথার্থভাবে বোঝেনি। ভেবেছিল তার লাভ বই লোকসান হবে না। অবশ্য অবনীকে আপাতদৃষ্টিতে অপছন্দ করার কিছু ছিল না–এমন কোনও স্থূল কারণ ললিতা খুঁজে পায়নি যাতে অবনীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। অন্য কোনওদিকে, যা স্থূল নয়যা সূক্ষ্ম এবং ভিতরের দিক-সেদিকে তাকাবে এমন সুযোগ ললিতা পায়নি, অবনী তাকে সে অবসর দেয়নি। সম্ভবত, ললিতা তার শারীরিক লক্ষণগুলির জন্যে মনে মনে যে দাম স্থির করে রেখেছিল অবনী প্রথম থেকেই তার বেশি ললিতাকে দিয়েছে; অনন্য এতটা দেবে কি দেবে না ললিতা জানত না; প্রাপ্তির আধিক্যে সে সন্তুষ্ট ও লোভী হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া, ললিতা অবনীর প্রবল আকাঙ্ক্ষার কাছে আত্মরক্ষা করতে পারেনি, তার প্রয়োজনও সে অনুভব করেনি তখন। এসব সত্ত্বেও ললিতা অবনীকে সঙ্গী হিসেবে, পুরুষ হিসেবে পছন্দই করেছিল।
বিয়ের পর বাদুড়বাগনের বাড়িতে ওরা কয়েক মাস যেন হাওয়ায় ভেসে ছিল। চার-পাশে তখন খুশি ঠিকরে উঠছে; সুখ, সুখ আর সুখ। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে মনে হত ওদের হাতে কেউ যেন সুখের একটা বড়সড় নোট ধরিয়ে দিয়েছে, দিয়ে বলেছে: যাও, খরচ করো। ওরা দুজনে সারা দিন ভরে সেই নোটের ভাঙানি খরচ করে রাত্রে বিছানায় শুয়ে দেখেছে তখনও অনেক অবশিষ্ট থেকে গেছে। অবশিষ্ট যা থেকে যেত তা খরচ করার জন্যে ওরা কৃপণতা করেনি; কারণ সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলেই আবার একটি সুখের নোট পাওয়া যাবে। এত সুখ-শুতে, বসতে, কথা বলতে, বেড়াতে কোথায় যে ছিল তা যেন তারা জানত না। অবনীরও মনে হত, সে আশাতীত তৃপ্তির মধ্যে রয়েছে; হয়তো এতটা সে প্রত্যাশাও করেনি।