অবনী চতুর নয়, ঠিক যতটা বুদ্ধিমান হলে তার উদ্দেশ্য ধরা মুশকিল হয়ে পড়বে–ততটা বুদ্ধিমানও নয়। সুরেশ্বর অন্তত বেশ বুঝতে পারছে, অবনীর আকর্ষণের পাত্র হেম।
বাস থানা পেরিয়ে গেল। সুরেশ্বর অন্যমনস্ক।
চাকরিতে উন্নতি চায় না এমন মানুষ বড় চোখে পড়ে না-সুরেশ্বর ভাবছিল–অবনী সেই উন্নতি উপেক্ষা করতে চাইছে। কেন? এ জায়গা ছেড়ে সে যেতে চায় না, বিজলীবাবু বললেন। কিন্তু কেন?
হেম। হেমের জন্যেই কি অবনী এ জায়গা ছেড়ে যেতে রাজি না?
কিন্তু আজ হেম কলকাতায় যাচ্ছে বলে সে তো স্টেশনে এল না। বিজলীবাবুর কথা মতন, দরকারি কাজে ভোরবেলাতেই বেরিয়ে গেছে অবনী। যে মানুষ এতটা কাজ বোঝে, দায়িত্ব বোঝে, সে আরও বড় দায়িত্ব নিতে অরাজি কেন?
সুরেশ্বর রোদভরা মাঠের দিকে তাকিয়ে কী ভেবে যেন মৃদু হাসল।
৩. বিজলীবাবুর বাড়ি
১১.
বিজলীবাবুর বাড়ির সামনে এসে হর্ন দিল অবনী। আজ হাটবার, বিজলীবাবুর বাড়ির পেছন দিকে মস্ত মাঠ, ওই মাঠে হাট বসে; মাঠের পশ্চিম দিয়ে রেললাইন চলে গেছে। দশারা গেছে পরশু, তবু হাটের কাছাকাছি বলে দশারার মেলাটা হাটের ওপর এখনও ছড়ানো-ছিটোনো রয়েছে, পেট্রম্যাক্স আর কার্বাইডের আলো চোখে পড়ে, নাকে ভেসে আসে শুকনো শালপাতার আর রেড়ি কিংবা তিল তেলের গন্ধ, কলরব এখনও কানে আসে।
অবনী আরও একবার হর্ন দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। বিজলীবাবুর বাড়ির কুয়ালার কাছে বাগান দিয়ে একটা বউ অন্দরে চলে গেল। অবনী তাকে দেখতে পেল, চিনতেও পারল; বিজলীবাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী, ছোট বউ।
বিজলীবাবুর প্রথম স্ত্রী অন্তঃপুরবাসিনী, কদাচিৎ তাঁকে বাইরে দেখা যায়; দ্বিতীয় অতটা নয়, অবনী তাঁকে অনেকবার দেখেছে। বড় থাকেন সংসার আর ধর্মকর্ম নিয়ে, ছোট থাকেন সংসার আর স্বামী নিয়ে। বাইরে থেকে মনে হয় বিজলীবাবুর সংসার ছোট–তিনজন মাত্র লোক, আসলে সংসার আরও বড়; বাস-অফিসের জনা দুই এই সংসারেরই অন্ন খায়, একটি ছেলেকে বিজলীবাবু নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, বাঙালির ছেলে, স্কুলে পড়ে; এর ওপরেও প্রায়ই শহর থেকে বিজলীবাবুর চেনাজানা কেউ না কেউ কাজেকর্মে এসে তাঁর বাড়িতে ওঠে। বাস-অফিসের ম্যানেজারিতে এত বড় সংসার চলে না, বাবা বেঁচে থাকতেই কিছু জমি জায়গা করেছিলেন, সেই জমি জায়গা বিজলীবাবু বেশ কিছু বাড়িয়েছেন, বাজারের দিকে গোটা দুই ভাড়া বাড়ি আছে, সব মিলিয়ে মিশিয়ে সচ্ছল ভাবেই চলে যায়।
কাঠের ফটক, সামান্য কটা গাছপালা, সিঁড়ি কয়েক ধাপ-তারপরই ঢাকা বারান্দা। খোলা দরজা দিয়ে বিজলীবাবু বাইরে এলেন,হাত তুলে বললেন, আসছিদুমিনিট। বিজলীবাবুআবার ভেতরে ঢুকে গেলেন।
অবনী সামনেটায় পায়চারি করতে করতে সিগারেট ধরাল। সন্ধে হয়ে এল, হাটের দিক থেকে গুঞ্জন ভেসে আসছে, কোথাও কে যেন ঢোল পিটছে, বোধহয় ধোপপট্টিতে। রেল লাইনের দিক থেকে গুরুগুরু শব্দ উঠেছে, মালগাড়ি আসছে হয়তো। অবনী বারান্দার দিকে তাকাল, পুবের ঘরে বাতি জ্বালল, শাঁখ বাজছে, জানলায় বিজলীবাবুর ছোট বউ।
বিজলীবাবুর মুখেই অবনী শুনেছে, তাঁর দুই স্ত্রী সহোদরা ভগিনী। বড় এবং ঘোটর মধ্যে বয়সের তফাত বছর পাঁচেকের। দুজনেরই মুখের আদল গড়ন-টড়ন একই রকমের প্রায়, তবে ছোট যেন বড়োর চেয়ে সুশ্রী, গায়ের রংও মাজা। অবনী নিজে যেটুকু দেখেছে তাতে তার মনে হয়েছে, হোটর সমস্ত মুখের মধ্যে চমৎকার একটি প্রসন্ন ভাব আছে, বেশ হাসিখুশি, বিজলীবাবুর যোগ্য স্ত্রী। বড় একেবারে বর্ষীয়সী গৃহিণী শান্ত, গম্ভীর। বিজলীবাবু, অবনীর ধারণা, বড়কে খাতির করেন বেশি, ভালবাসেন ছোটকে বেশি। বড়র জীবনে স্বামী এখন সঙ্গী নয়, গৃহকর্তা বা অভিভাবক। বিজলীবাবুর কাছে শোনা, বড় আলাদা ঘরে থাকেন, পুজোআচা করেন, সংসারের দায় বয়ে বেড়ান। ছোটও সংসার নিয়ে থাকেন, তবু তাঁর সঙ্গে স্বামীর শোয়াবসা হাসিঠাট্টার সম্পর্কটা আছে। বিজলীবাবু বলেন, মিত্তিরসাহেব, আমার দুদিকে দুই কলাগাছ আমি শালা মহারাজ। আমার বড়টি হল গিয়ে নারায়ণের লক্ষ্মী, আর ছোটটি হল আমার মেনকা-টেনকা। …আমি ভাগ্যবান পুরুষ।
অবনী সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিয়ে মনে মনে হাসল। ততক্ষণে বিজলীবাবু বেরিয়ে এসেছেন।
বিজলীবাবুর হাতে একটা টিফিন কেরিয়ার, কাঁধে বড় সাইজের ফ্লাস্ক।
অবনী অবাক হয়ে বলল, এসব কী?
টিফিন কেরিয়ারটা হাতে করে তুলে দেখিয়ে বিজলীবাবু বললেন, এটা সুরেশ মহারাজের। বাড়ি থেকে দিয়ে দিল। বলে হাতটা নামালেন বিজলীবাবু, মিষ্টি-ফিষ্টি পায়েস আছে। …আর এইটে– বিজলীবাবু ফ্লাস্ক দেখিয়ে এক চোখ টিপে হাসলেন, আমাদের। পথে তেষ্টা-টেষ্ঠা পাবে তো৷
অবনী জোরে হেসে উঠল। ওটাও কি বাড়ি থেকে দিয়েছে?
তাই কি দেয়, মিত্তিরসাহেব। …এর জন্যেই দেরি হয়ে গেল। কত হাইড অ্যান্ড সিক করে তবে মিশিয়ে-ফিশিয়ে আনলুম।
আপনার হাইড অ্যান্ড সিক আছে নাকি? অবনী হাসছিল।
না, তা নেই। তবে দেবতা বুঝে প্রণামী। যাচ্ছি সুরেশ-মহারাজার কাছে–এ-জিনিস তো নিয়ে যাওয়া যায় না, তার ওপর গাড়ি করে রাত্তির বেলায় আসা-যাওয়া–মদ্য নিয়ে যাচ্ছি জানলে বউ কি আর আস্ত রাখত।
গাড়িতে এসে বসল দুজনে। বিজলীবাবু পিছনের সিটে টিফিন কেরিয়ারটা ঠিক করে রাখলেন, সাবধানে; ফ্লাস্কটা তাঁর পাশেই থাকল।