সুরেশ্বর টাকা তোলার ফর্ম লিখে দিয়ে বসে বসে শর্মাজির সঙ্গে গল্প করছিল। বিজলীবাবু পাশে এসে দাঁড়ালেন।
.
পোস্ট অফিসের কাজ সেরে সুরেশ্বর গেল বাজারে। কাছেই বাজার। বাজারে ছেদিলালের দোকানে টাকা পয়সা মেটাল। তারপর বিজলীবাবুর সঙ্গে বাস অফিস। বাস অফিসে বিজলীবাবুর ঘরে বসে জল খেল, চা খেল। বাস ছাড়তে এখনও কিছু দেরি, মিনিট কুড়ি। দশটা বেজে গেছে।
বিজলীবাবু বললেন, পুজোর মধ্যে একদিন আসুন। কবে আসবেন?
সুরেশ্বর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিল। ওপাশে রাস্তার ও-দিকটায়–গাছের ছায়ায় বাজার বসে গেছে, শাকসবজি, মাছ ডিম। এ সময় এখানে বাজার একটু বড় হয়েই বসে, পুজোর মুখে কলকাতা পাটনা থেকে তোকজন আসে, বাবুদের জন্যে গাঁ গ্রাম থেকে ব্যাপারিরা মাথায় সওদা নিয়ে ছুটে আসে ভোরবেলায়, দুপুর নাগাদ ফিরে যায়। আজকের বাজার তেমন বড় নয়, কাল থেকে আরও আসবে অনেকে, সকালের দিকটা বেশ ভিড় হবে। কিছু ছেলেমেয়ে, প্রবীণপ্রবীণাকে সুরেশ্বর দেখতে পেল, বাজার করছে ঘুরে ঘুরে। কারও কারও মাথায় ছাতা।
বিজলীবাবু পান চিবোতে চিবোতে বললেন, কবে আসছেন তা হলে?
সুরেশ্বর বিজলীবাবুর দিকে তাকাল, হাসল, নেমন্তন্ন করছেন?
গরিবের ঘরে দুমুঠো খাবেন এতে আর কথা কী!
আসব একদিন।
কবে?
সুরেশ্বর আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আসব।
অষ্টমীর দিন এলে-সকালে; বিকেলে বিজলীবরণ সন্ধিপুজোয় বসবে। বলে বিজলীবাবু আপন রসিকতায় জোরে জোরে হাসলেন।
সুরেশ্বর বলল, অভ্যেসটা এবার ছাড়ার চেষ্টা করুন না। বয়স হয়ে যাচ্ছে তো।
বিজলীবাবু কৃত্রিম বিস্ময়ে সুরেশ্বরের মুখ দেখতে দেখতে বললেন, এটা আপনি কী বলছেন মহারাজ? কাকে ছাড়ব? … বিজলীবাবু এমনভাবে কাকে ছাড়ব বললেন যে সুরেশ্বর হেসে ফেলল।
বিজলীবাবু সামান্য পরেই বললেন, আমরা কি ছাড়ার লোক, মহারাজ! সে হলেন আপনারা ছাড়ার লোক। সবই ছাড়ছেন। সংসার ছাড়লেন, সুখ আহ্লাদ ছাড়লেন, ফুর্তি-টুর্তি তাও ছাড়লেন। আরও কত কী ছাড়ছেনছাড়বেন–কে বলতে পারে!
সুরেশ্বর বিজলীবাবুর চোখে এমন এক ধরনের হাসি দেখল যা কেমন ধূর্তের মতন। বিজলীবাবু যে ঠিক কী বলতে চাইলেন সুরেশ্বর বুঝল না।
আপনারা সব ছাড়েন, আমরা ধরি। ছাড়ার মজা কী জানেন, একবার ছাড়তে শুরু করলে ছাড়ার মজা ধরে যায়, নেশা ধরে যায়। আজ মদ ছাড়ব, কাল চাকরি ছাড়ব, পরশু বউ ছাড়ব… ছাড়তে ছাড়তে একেবারে বুদ্ধদেব হয়ে যাব। …ওই জন্যেই তো ওপথে যাইনি।
সুরেশ্বর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল, বলল, যাই, আর বোধহয় সময় নেই।
বিজলীবাবু তাঁর টেবিল থেকে কিছু কাগজপত্র উঠিয়ে ড্রয়ারে রাখলেন, বললেন, চলুন, আপনাকে তুলে দিয়ে আমি একবার দুর্গাবাড়ি যাব।
বাইরে এসে বিজলীবাবু তাঁর সাইকেল নিলেন, হ্যাঁন্ডেলে একটা শোলার হ্যাট ঝুলছে। বর্ষায় ছাতা ঝোলে, রোদে তিনি শোলার হ্যাট চাপিয়ে নেন মাথায়।
রাস্তায় নেমে বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেবের একটা বড় প্রমোশন হচ্ছে, শুনেছেন?
না।
মিত্তিরসাহেবের ওপরঅলা চলে যাচ্ছে পাটনা, সেই জায়গায় মিত্তিরসাহেবকে কাজ করতে হবে।
এ তো সুখবর।
আমাদের কাছে সুখবর, তবে যাঁর খবর তিনি তো খাদ্ধা হয়ে উঠেছেন।
কেন?
তা জানি না। মিত্তিরসাহেব এ জায়গা ছেড়ে যেতে রাজি না। ওপরঅলার জায়গায় কাজ করতে হলে অন্য জায়গায় যেতে হবে।
সুরেশ্বর কোনও কথা বলল না। হাঁটতে লাগল, সামনেই বাস।
বিজলীবাবুই কথা বললেন। মিত্তিরসাহেব মানুষটি, বুঝলেন মহারাজ, অদ্ভুত! কী বলে যে, মিস্টিরিয়াস–তাই। জীবনে উন্নতি করার সুযোগ এলে মানুষ খাদ্ধা হয় এমন আর দেখেছেন?
সুরেশ্বর মাথা নাড়ল অন্যমনস্কভাবে।
বাসের কাছে এসে বিজলীবাবু ড্রাইভারকে কী যেন বললেন। তারপর সুরেশ্বরকে ফার্স্ট ক্লাসে উঠিয়ে দিলেন। আপনি রোদে লাঠটা থেকে হাঁটবেন না, বাস আপনাকে গুরুডিয়ায় পৌঁছে দেবে।
সুরেশ্বর আপত্তি করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার সেই আপত্তি গায়ে না মেখে বিজলীবাবু সাইকেলে উঠে চলে গেলেন। সাইকেলে ওঠার আগে শোলার হ্যাটটা মাথায় চাপিয়ে নিয়েছেন।
বাস ছাড়ল। সুরেশ্বরের পাশে জনা তিনেক শহরের প্যাসেঞ্জার। তার মধ্যে জানলার ধার ঘেঁষে বিবাহিতা একটি মেয়ে বসে আছে। অবাঙালি। স্বামী-স্ত্রীতে কথা বলছিল, তৃতীয় ব্যক্তিটি ওদেরই আত্মীয়, সেও কথা বলছে।
যেতে যেতে সুরেশ্বরের কেন যেন অবনীর কথাই মনে পড়ছিল। ভদ্রলোক যে কিছুটা অন্য ধরনের এই ধারণা সুরেশ্বরের পূর্বেই হয়েছিল। ইদানীং অবনীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে এবং তার আচরণ দেখেও সুরেশ্বরের সে-ধারা ভাঙেনি,বরং তার মনে হচ্ছিল: অবনী ঠিক যতটা তিক্ততা ও বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে ততটা তিক্ত ও বিতৃষ্ণ মানুষ সে নয়। ওর অনেক আচরণ এখনও অপরিণতের মন, কথাবার্তায় অনেক সময় আবেগের তাপ থাকে। সেদিন অতটা রাতে সে নিতান্ত তুচ্ছ কারণে গুরুডিয়ায় গিয়ে হাজির হয়েছিল। কারণটা যে তুচ্ছ সে নিজেও জানত, এবং তা গোপন করার চেষ্টাও তেমন করেনি। বড় একটা দুর্যোগ ঝড়বৃষ্টি গেল মাথার ওপর দিয়ে তাই নাকি খবর নিতে গিয়েছিল: খোঁজ নিতে এলাম কেমন আছেন? …আমি তো ভেবেছিলাম আপনাদের আশ্রমের চালাফালা উড়ে গেছে। কিছুই তো হয়নি দেখছি।