জানি, বিজলীবাবু মাথাটা কাত করে বললেন, সবই জানি। দু-একটা টাকা সবাই দিয়েছে, সে আপনার মন রাখতে মান বাঁচাতে। …যা দিয়েছে তার পাঁচ গুণ আদায়ও করে নিয়েছে।
তা হলেও!
আপনার টাকার আর দরকার নেই, মহারাজ?
সুরেশ্বর বিজলীবাবুর মুখের দিকে তাকাল, তাকিয়ে চুপ করে থাকল। শেষে বলল, আছে। কত কী করার আছে অর্থাভাবে পারছি না।
ঠিক এই মুহূর্তে সুরেশ্বর যেসব অভাব বোধ করছে বা করতে পারলে লোকের সুবিধে হয় তার কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগল। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন চশমা দেবার একটা ব্যবস্থা করা। সেই শহর ছাড়া এই অঞ্চলের কোথাও চশমার দোকান নেই, শহরেও মাত্র একটি দোকান, অত্যধিক দাম নেয়, গরিব মানুষের পক্ষে শহরে আসা যাওয়া করা, চশমা কেনার টাকা জোটানো খুবই কষ্টকর। যদি সুরেশ্বর চশমাও দিতে পারত সুবিধে হত। অল্প খরচে, তেমন ক্ষেত্রে বিনা খরচেই অনেকে চশমা নিতে পারত। …অন্ধদের থাকার ঘরবাড়িও বাড়ানো দরকার, আরও কিছু অন্ধজনকে রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হয়। ওদের হাতে জিনিস দিলে আরও কত কাজ করতে পারে, অর্থাভাবে মালপত্র দেওয়া যায় না তেমন।
কথা বলতে বলতে পোস্ট অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে গেল সুরেশ্বর।
বিজলীবাবু বললেন, ময়দা বেশি মাখবেন না, শেষকালে লুচি বেলারও লোক পাবেন না, ভেজে উঠতেও পারবেন না। যা করবেন–এসব জায়গায় অল্প করেই করবেন।
সুরেশ্বর হাসল। একে একে সবই হবে। আপনারা পাঁচজন তো রয়েছেন।
বিজলীবাবু মাথা নাড়লেন, মজা করে করে বললেন, আপনার মতন বিজ্ঞ লোক কী করে এই কথাটা বললেন? পাঁচজনে একসঙ্গে বসে তাসপাশা খেলতে পারে, আফিং মদ গাঁজা পঞ্চরং চড়াতে পারে; কিন্তু পাঁচজনে কোনও সৎ কর্ম হয় না।
অসৎ কর্ম হয়…? সুরেশ্বর লঘু স্বরে, হাসিমুখে বলল।
তা তো হয়ই। ..বিদ্যেটা আপনার ঠিক জানা নেই কি না, জানা থাকলে বুঝতেন কথাটা যা বলেছি। খাঁটি কথা।
সুরেশ্বর কেমন পরিহাস করেই শুধোল, বিদ্যেটা আপনারই কি জানা আছে?
তা খানিকটা আছে, বিজলীবাবুও হাসিমুখে জবাব দিলেন; তারপর বললেন, দেখুন মহারাজ, আপনি আমার চেয়ে বয়সে ছোট–বেশ ছোট, তবে বিদ্যে বুদ্ধিতে অনেক বড়, মানুষও বড়। কিন্তু এই জগতের হালচাল আমি যত জানি, আপনি জানেন না।
কী রকম হালচাল?
বিজলীবাবু সুরেশ্বরের হাসিহাসি মুখের দিকে তাকালেন। যেন ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই বলতে পারেন। অবশ্য কিছু বললেন না তেমন, শুধু বললেন, জগতে যখন রয়েছেন, এর হালচাল কিছুটা আপনিও বোঝেন, পরে আরও বুঝবেন।
পোস্ট অফিসের সামনে পৌঁছে গেল ওরা। সিঁড়িতে ডাক পিওন।
বিজলীবাবু দাঁড়ালেন, কিছু আছে নাকি, রামেশ্বর?
রামেশ্বর মাথা নেড়ে না বলে চলে যেতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়াল, হাতে কিছু চিঠি, বাকি থলিতে। হাতের চিঠি থেকে একটা খাম বার করে নিয়ে বলল, ইয়ে দেখিয়ে তো থোড়া।
বিজলীবাবু খামটা হাতে নিয়ে দেখলেন। জল পড়ে খামের ওপরে লেখা কাঁচা হাতের ঠিকানা ধুয়ে একেবারে অস্পষ্ট হয়ে গেছে, বোঝা যায় না। লক্ষ করে দেখে বিজলীবাবু বললেন, বিজলি অফিসের সাহেবের বলেই তো মনে হচ্ছে–মিত্তিরসাহেবের।
মিত্তির সাহাব! … হামারা ভি ওইসি মালুম হোথা থা। …সাহেব কো এক রসিদ ভি হ্যায়।
কীসের রসিদ?
মানিঅর্ডারকা।
বিজলীবাবু রামেশ্বর-পিয়নের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন। চিঠিটা তার হাতে ফেরতও দিলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, দেখি তো, হাতের লেখা যদি মেলে…।
রামেশ্বর কিছু বুঝল না, রসিদ বের করে এগিয়ে দিল। মনিঅর্ডার পৌঁছে তার রসিদটা ফিরে এসেছে। বিজলীবাবুনামসইটা দেখলেন। ললিতা মিত্র। কলকাতার স্ট্যাম্প তো বটেই। টাকার অঙ্কটাও দেখে নিলেন।
রসিদটা ফেরত দিয়ে বিজলীবাবু বললেন, না, আলাদা লেখা। ও চিঠি মিত্তির সাহেবেরই হবে। তবে সাহেবকে এখন অফিসে পাবে না, ভোরবেলায় কাজে বেরিয়ে গেছেন, বাড়িতে দিয়ে দিয়ো চিঠি।
রামেশ্বর চলে গেল। সুরেশ্বর পোস্ট অফিসের মধ্যে ঢুকে গেছে।
বিজলীবাবু ডাকঘরের বারান্দায় সামান্য সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন। বেশ যেন চিন্তায় পড়েছেন। ললিতা মিত্র! ললিতা মিত্র কে? মিত্তিরসাহেবের মা নেই, বোন নেই; বউ আছে বলেও তো তিনি শোনেননি। বিয়ের কথায় মিত্তিরসাহেব বরাবর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে হেসে বলেছেন: চেষ্টা করেছিলাম; কপাল মন্দ! এ ধরনের কথা থেকে কিছু বোঝা যায় না, যাও বা যায়–তাতে মনে হয়, বিয়ে করব ভেবেছিলেন হয়তো, কিন্তু বিয়ে করেননি।
পাকানো সিগারেট, বারে বারে নিবে যায়; বিজলীবাবু আবার সিগারেট ধরিয়ে নিলেন। খামের চিঠিটা যে মিত্তিরসাহেবের তাতে খুব বেশি সন্দেহ হচ্ছে না। অফিসের নামটা (ভুল নাম এবং বানান সত্ত্বেও) মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিল। এই অফিসে এ এন মিত্র (মিত্র যদিও পড়া যায়নি; এ এন গিয়েছিল) আর কেউ নেই। কাঁচা হাতের ঠিকানা, একেবারে বাচ্চা ছেলেমেয়ের যেমন হয়। ললিতা মিত্রর নাম সই আর এই খামের ঠিকানা একই হাতের লেখা নয়। চিঠিটাই বা কে লিখল? মিত্তিরসাহেব তো কখনও বলেননি তাঁর আত্মীয়স্বজন কেউ আছে সংসারে। বন্ধুবান্ধবের কথা অবশ্য বলেছেন। ওই চিঠি কি তবে বন্ধুদের কারও বাড়ির কেউ লিখেছে? কিন্তু টাকাটা?
মিত্তিরসাহেব বেশ রহস্যময় পুরুষ। বিজলীবাবু আপন মনেই মাথা নাড়লেন, আচ্ছা, আজ রাত্রে দেখা যাবে।