সুরেশ্বর হাসল, তা অল্পস্বল্প বোঝে বইকি! ডাক্তারিটা তো পাশ করতে হয়েছে। বিজলীবাবু সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলেন না, পরে বললেন, তবে থাক, দুর্গাবাড়ি আর না গেলেন, পোস্ট অফিসেই যাওয়া যাক। ওখান থেকে যদি বৈজুর রিকশাটা পাওয়া যায়, তবে না-হয় দুর্গাবাড়ি যাওয়া যাবে।
বেলা এমন কিছু নয়, তবু শরতের রোদ এত ঝকঝকে যে চোখে লাগছিল, তাত ফুটে উঠেছে। গাছের ছায়া ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিজলীবাবু সিগারেট ধরালেন।
সুরেশ্বর শুধোল, এবার লোকজন কেমন আসছে, বিজলীবাবু।
আজ বিকেল থেকে বোঝা যাবে। কাল কিছু এসেছে। তা মন্দ না।
উমেশবাবু এসেছেন?
না; কাল আসবেন বোধ হয়।
আপনাদের পুজো কেমন হচ্ছে?
নতুন আর কী হবে–যেমন হয় বরাবর বলে বিজলীবাবু একটু থেমে সুরেশ্বরের মুখের দিকে চেয়ে কিছু দেখলেন, বললেন, আপনি তো জানেন মশাই, আমি লোকটা মদ্যটদ্য খাই, উপসর্গ এক-আধটু আছে, তবে ড্যাং ড্যাং করে বাজনা বাজিয়ে, কলকাতার বড়লোক বাবুদের বাড়িতে এক থালা করে প্রসাদ, দুকাঁসি করে সরু চালের খিচুড়ি ভোগ পাঠিয়ে অর্থ অপব্যয় করতে রাজি না। বিজলীবাবু ঠোঁটে চেপে সিগারেটে টান দিলেন বার কয়েক, আবার বললেন, নবমীর দিন ভিখিরি-টিখিরি খাওয়ানো হয় এখানে নিজেই দেখেছেন–সেটা হোক, বরাবর হয়ে আসছে, আমি তাতে কথা তুলছি না। কিন্তু বড়লোক বাবুদের বাড়ি বাড়ি একরাশ করে ফল-মিষ্টি আর ভোগ পাঠানোর দরকারটা কী? …এই নিয়ে সেদিন ঝগড়া, হরিহরের সঙ্গে। বলে, কলকাতার ওই বড়লোক মশাইদের কাছ থেকে পঁচিশ, পঞ্চাশ, একশো করে চাঁদা পাই, খাতির না করলে হবে কেন? .. চুলোয় যাক তোর খাতির…
বিজলীবাবু যে কোনও কারণে অসন্তুষ্ট এবং উত্তেজিত সুরেশ্বর বুঝতে পারল। বলল, ওঁরা অবশ্য মোটা চাঁদা দেন। না এলেও বছরের চাঁদা ঠিক পাঠিয়ে দেন বলে শুনেছি।
তাতে কার কী, টাকা দাও বলে ঠাকুরের ভোগ তুমি শালা তোমার কুকুরকেও খাওয়াবে। …বিশ্বাস করুন মহারাজ, স্বচক্ষে দেখেছি। কলকাতার এক ইংলিশবাবুচারবেলা ডিম, মুর্গির ঠ্যাঙ, মাছ কলা ফল খাচ্ছে, ভোগ গেল ঠাকুরের, মেয়েরা একটু আধটু ঠোঁটে ছোঁয়াল কি ছোঁয়াল না, বাড়ির কুকুরকে খাইয়ে দিল। … রাগের চোটে বিজলীবাবু সামনাসামনি মহারাজ বলে সম্বোধন করে ফেললেন। এটা তিনি সাধারণত করেন না। সুরেশ্বর অবশ্য জানে বিজলীবাবু তাকে মহারাজ-টহারাজ বলেন।
কী বলবে সুরেশ্বর, চুপচাপ থাকল।
বিজলীবাবু শার্টের পকেট হাতড়ে দেশলাই বের করলেন। ঠাকুরফাকুর কাঁধে করে নাচানাচি আমার নেই। হিন্দুর ঘরে জন্মেছি দুর্গা কালী লক্ষ্মী দেখলে বড় জোর একটা পেন্নাম ঠুকি, ব্যাস। কথা হল, আজ সতেরো আঠারো বছর ধরে এখানে বাঙালিরা দুর্গাপুজো করছে সেটা তো আর আমরা তুলে দেব না। আমি না হয় অষ্টমীর দিন পাঁঠার মাংস চিবিয়ে বোতল-ঠাকুর সামনে বসিয়ে অষ্টমী করলাম, কিন্তু আমার বউ দুটো তো অষ্টমীর উপোস করবে, অঞ্জলি দেবে, সন্ধিপুজো দেখবে…। বলুন আপনি, আমাদের বাড়ির বউ-টউ, ছেলেমেয়ে, বুড়ো বাপ-মা-এদের কাছে তো পুজোর একটা মূল্য আছে। ভক্তি-টক্তি তারাই করে; তাদেরই আনন্দ। তা ছাড়া আমি না হয় ঠাকুরফাকুর না মানলুম, অন্য লোক তো মানে। …আমার তাই সাফ কথা, পুজো আলবত করব, তবে বড়লোককে তোয়াজ করার জন্যে পুজো নয়।
সুরেশ্বর বলল, হরিবাবুদের সঙ্গে আপনার ঝগড়াঝাঁটি হল।
হল। ওই হরি আর বেঁটে কার্তিক–ওই দুটোই হচ্ছে হারামজাদা। দল গড়েছে, দল গড়ে কলকাতার কেষ্টবিন্ধুদের ভজিয়ে এখানে একটা আখড়া করার মতলব ফেঁদেছে, বোষ্টমদের আখড়া। খোল করতাল বাজাবে, বাতাসা খাবে। আমি বলেছি পুজো কমিটি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওসব করো। …আমার নাম বিজলীবরণ চক্রবর্তী, পঁয়ত্রিশ বচ্ছর এখানে আছি, তোমরা ভেবো না, দুদিনের যোগী এসে আমার ওপর টেক্কা মারবে।
ঝগড়াঝাটি করতে গেলেন কেন? সুরেশ্বর একটু হেসেই যেন বলল।
কেন করব না ঝগড়া! ওরা পুজোর টাকা চুরি করে, পাবলিক মানি নিয়ে বিজনেস করে… হরি-বেটা বাজারে একটা কাপড়ের দোকান দিয়েছে। কোথ থেকে দেয়?
সুরেশ্বর এই অপ্রিয় প্রসঙ্গটা চাপা দিতে চাইল। বলল, যেতে দিন। এসব কথা থাক।
বিজলীবাবু সিগারেট ধরিয়ে আবার টানতে শুরু করলেন। ডান দিকে রেললাইন, একটা ট্রলি চলে যাচ্ছে, সাদা ছাতার তলায় হাফ প্যান্ট আর শার্ট পরে অচিন্ত্যবাবু বসে আছেন, কুলি দুটো পায়ের কাছে, মোটরের ফটফট শব্দ হচ্ছে। দেখতে দেখতে ট্রলিটা কেবিন ছাড়িয়ে চলে গেল।
বাঁ দিকের পথ ধরল সুরেশ্বর, পোস্ট অফিস যেতে হলে এই পথটাই সুবিধের।
সামান্য এগিয়ে বিজলীবাবু বললেন, একটা কথা তা হলে স্পষ্ট করে বলেই ফেলি। মতলব ছিল, এবারে পুজো থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে আপনার হাতে তুলে দেব।
সুরেশ্বর যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে বিজলীবাবুর দিকে তাকাল। আমার হাতে?
বিজলীবাবু এমন করে চশমার আড়ালে চোখ উজ্জ্বল করে হাসলেন, মনে হবে যেন এই বিষয়ে তাঁর উদ্দেশ্যটি পূর্ব পরিকল্পিত। হাঁটতে হাঁটতে বললেন, সৎ কর্মে দু পয়সা গেলে গায়ে লাগে না। …তা ছাড়া এরা দুএকশো টাকা দেবে নাই বা কেন। এখান থেকে চোখ দেখাতে তো কম লোক যায় না।
সুরেশ্বর কেমন অস্বস্তি বোধ করল, প্রথম প্রথম এখানের সকলেই যার যা সাধ্য আমায় সাহায্য করেছে, বিজলীবাবু।