হেমদের হাসপাতালে হেমের চেয়ে কিছু ছোট প্রায় সমবয়সী বলা যায়–একটি মেয়ের সঙ্গে হেমের বন্ধুত্ব হয়েছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মেয়েটি নেকড়ার পুতুল তৈরি করত, তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সে প্রায় দীনের মতন সকলের কাছে ঘেঁড়া টুকরো টাকরা নেকড়া চাইত, উঁচ সুতো চাইত, রংটং আনতে বলত। হাসপাতালের প্রতিটি বিছানায় তার হাতের বিচিত্র নেকড়ার পুতুল দেখা যেত। ওর আত্মীয়স্বজন ছিল না বুঝি, কেউ আসত না। একদিন মাঝরাতে মেয়েটি মারা গেল, সকালবেলায় দেখে গেল তার বিছানায় মস্ত একটা নেকড়ার পুতুল, ধড় আছে, মাথা আছে হাত পা নেই।
এই মেয়েটির মৃত্যুতে হেম কেঁদে আকুল, দুঃখে মুহ্যমান। সুরেশ্বর সেবার যখন হেমের সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করতে গেল, হেম শুধু তার বন্ধুর কথা বলেছে আর কেঁদেছে।
হেম বলেছিল: ও বলত সেরে উঠলে ও পরিষ্কার নেকড়া দিয়ে পুতুল করবে।
কেন, পরিষ্কার নেকড়া কেন?
এখানে সব রোগ-টোগের ছোঁয়া, এসব পুতুল তো বাইরে যেতে দেয় না।
ও!
পরিষ্কার নেকড়া দিয়ে পুতুল করলে সবাই নেবে।
পুতুল বেচবে?
ওর কেউ ছিল না; একমাত্র দিদি; খুব গরিব। …পুতুলের দোকান করলে বিক্রি হত।
ও!
হেম চুপ করে থেকে তারপর হঠাৎ বলল, যাদের কেউ কোথাও নেই তাদের কী কষ্ট! ভগবান যদি ওর জন্যে কাউকে রাখত…
সুরেশ্বর মাথা নিচু করে ফেলেছিল, নয়তো কেঁদে ফেলত সেদিন।
হেম হাসপাতালে থাকার সময় মমতা ও ভালবাসা জেনেছিল।
তারপর হেম সুস্থ হয়ে ফিরে এল। সুরেশ্বর হঠাৎ কেমন এক মুক্তি অনুভব করল, আনন্দ। এ আনন্দ অবর্ণনীয়। যেন সে নিজেই পুনর্জন্ম লাভ করেছে। হেমকে নিয়ে ঘাটশিলায়, সঙ্গে মাসিমা। সারাটা সকাল, দুপুর, সন্ধে, রাত আট নটা পর্যন্ত তার পাশে হেম থাকত। বেড়াতে বেরিয়ে কোনও কোনওদিন হেম গুনগুন করে সুখের গান গেয়ে উঠত। কোনও কোনওদিন বা বলত, আমার এখন সব ভাল লাগে, ধুলো বালি রাস্তা, সকাল বিকেল…
আমাকে কেমন লাগে?
হেম আড়চোখে চোখে দেখত, তারপর বলত, লাগে না।
লাগে না! সে কী! ভালমন্দ একটা কিছু না লাগলে হয়!
কী জানি! নিজেকে আবার কেমন লাগবে মানুষের– বলে মুখ টিপে হাসত।
সুরেশ্বর অনুভব করত হেম সুরেশ্বরকে নিজের অঙ্গীভূত করে নিয়েছে, নিজের অন্তরে মিশিয়ে নিয়েছে, সে আর আলাদা কিছু নয়, হেমের মধ্যেই সে আছে।
হেমের নরম গালে গাল রেখে সুরেশ্বর একদিন বলেছিল, হেম, অসুখের পর তুমি আরও সুন্দর হয়ে গেছ। …
তারপর কলকাতায় ফিরে এসে সুরেশ্বরের হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল। যা তার কাছে অবধারিত ও সত্য ছিল, ভালবাসা ছিল, সুন্দর ছিল–অকস্মাৎ যেন সেখানে দ্বিধা এল; মনে হল এই ভালবাসা বড় কষ্টদায়ক। এ-রকম কেন হল? সুরেশ্বর যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, কেন?
আচমকা সে গাড়ির হর্ন শুনতে পেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝল অবনী এসেছে। অবনী এর মধ্যে আরও কয়েকবার এসেছে, কিন্তু এতটা রাত করে কখনও নয়। আজ এতটা রাত করে অবনী এল কেন? সুরেশ্বর কিছু বুঝতে বা অনুমান করতে পারল না।
.
১০.
কলকাতার গাড়ি এইমাত্র ছেড়ে গেল। হৈমন্তীকে উঠিয়ে দিতে এসেছিল সুরেশ্বর, ট্রেন ছেড়ে গেলে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে ফিরতে লাগল। পাশে বিজলীবাবু।
বিজলীবাবুর সঙ্গে বাস-স্ট্যান্ডে দেখা হয়েছিল, গাড়ির আর সময় নেই তখন, সুরেশ্বরদের মালপত্র সমেত স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়ে বিজলীবাবু বুকিং অফিসে ঢুকে টিকিট কেটে একেবারে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গেই প্ল্যাটফর্মে হাজির হলেন।
ফেরার পথে রেলের দু-একজন বাবু-টাবু–প্ল্যাটফর্মে যারা ছিল তাদের সঙ্গে সুরেশ্বর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলল; সকলেই তার চেনা-জানা, দেখা হলে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলতেই হয়, খোঁজখবরও করতে হয় এর ওর। সুরেশ্বর সম্পর্কে এদের সকলেরই কেমন একটা শ্রদ্ধার ভাব আছে, কৌতূহলও আছে হয়তো। বিশেষত, আজ হৈমন্তীকে তুলে দিতে এসে সুরেশ্বর সেটা অনুভব করতে পারল।
ওভারব্রিজ দিয়ে না উঠে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্ত দিয়ে নামল, লাইন পেরিয়ে ঢালু মতন জায়গাটা দিয়ে রাস্তায় উঠল সুরেশ্বর। গোড়ালির ব্যথাটা এখনও পুরোপুরি সারেনি। আসার সময় ওভারব্রিজের সিঁড়ি উঠে ব্যথাটা আবার বোঝা যাচ্ছিল; ফেরার সময় তাই আর সিঁড়ি ভাঙল না।
রাস্তায় উঠে বিজলীবাবু বললেন, দুর্গাবাড়ির দিকটা একবার ঘুরে যাবেন নাকি?
দুর্গাবাড়ি খানিকটা দূর, জোরে জোরে হাঁটলেও মিনিট কুড়ির রাস্তা। যেতে আসতে খানিকটা সময় যাবে, এতটা হাঁটাহাঁটিতে আবার গোড়ালি ব্যথা করবে কিনা তা-ও সুরেশ্বর বুঝতে পারল না। পোস্ট অফিসেও একবার যাবার দরকার। সুরেশ্বর বলল, আমায় যে একবার পোস্ট অফিসে যেতে হবে। টাকা তুলব।
ফেরার পথে যাবেন–, বিজলীবাবু বললেন, এখনও নটা বাজেনি। দশটার মধ্যে গেলেই চলে। বিজলীবাবু সময়ের ব্যাপারটা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না।
সুরেশ্বর বলল, এতটা হাঁটব কী না ভাবছি।
বেশ ব্যথা?
না, খুব একটা নয়। ব্যথা তো ছিলই না প্রায়, সিঁড়ি উঠতে গিয়ে হয়তো ঠিক মতন পা পড়েনি কোথাও, খচখচ করছে।
হাড়-টাড় ভেঙেছেন নাকি
? না, সুরেশ্বর হাসল, হাড় ভাঙলে কি এত অল্পে রেহাই দিত। …হেম তো বলল, স্প্রেইন।
বিজলীবাবু সুরেশ্বরের মুখের দিকে তাকালেন, উনি কি এসবও বোঝেন?