এরকম হতে পারে সুরেশ্বর পূর্বে যে ভাবেনি তা নয়; তবে সে এতটা ভাবেনি। সে আশা করেছিল, হৈমন্তীর পক্ষে ক্রমশ এটা মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
আজ বেশ কয়েক বছর হৈমন্তীর সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। চিঠিপত্রেই বেশি, কদাচিত কলকাতায় গেলে দেখাসাক্ষাত ঘটত। হেমদের বাড়িতেই সে উঠত অবশ্য, কিন্তু সেই সাময়িক সাক্ষাতের মধ্যে সুরেশ্বর স্পষ্ট করে কিছু বোঝেনি। বোঝেনি যে, হেমের স্বভাবও বদলে যাচ্ছে। ডাক্তারি পড়াশোনা নিয়ে হেম তখন ব্যস্ত, বয়সের একটা পরিবর্তনও সাধারণত থাকে। হেমের বয়সোচিত পরিবর্তন ঘটেছে এটা বোঝা যেত। বোঝা যেত, হেম আগের তুলনায় অনেক গম্ভীর, আত্মমগ্ন স্বল্পবাক হয়ে উঠেছ। সুরেশ্বর অন্য পরিবর্তন দেখতে পায়নি, বুঝতে পারেনি। হেম কখনও স্পষ্ট করে চিঠিপত্রেও বোঝায়নি।
এখানে আসার পর থেকে হেমকে সুরেশ্বর যেন অল্পে অল্পে নতুন করে চিনছে। যে-হেম সুরেশ্বরের খুব বেশি চেনা ছিল, সেই হেম আর আজকের হেমে অনেক তফাত। অল্প বয়সের বা তরুণী হেমকেই সুরেশ্বর নিবিড় করে চিনত। সেই আঠারো উনিশ কি কুড়ি বছর বয়সের হেমের সঙ্গে আজকের পরিণত হেমের পার্থক্য অনেক।
সুরেশ্বর এখনও সেই হেমকে স্পষ্ট করে দেখতে পায় যেন। তাকে বুঝি অনুভব করা যায়। কুঁড়ি ফেটে ফুল ফোঁটার মতন হেম তখন ফুটে উঠছে, জীবনের চতুর্দিকে চঞ্চল বাতাস, তার সবটুকু যেন দুলত, সে সতত অধীর ছিল, উজ্জ্বল, নির্মল, বিভোর ছিল। সুরেশ্বরের তখন মনে হত তার চোখের মণিতে হেমের মুখ স্থির হয়ে আছে। হেমের কথা ভেবে দিনের কতটা সময় যে কাটত তাও সুরেশ্বর হিসেব করে দেখত না। হঠাৎ ওই বয়সে হেমকে তার ভাগ্য এক গভীর দুঃখ ও নৈরাশ্যের মধ্যে ছুঁড়ে দিল। আজ বোঝা যায় না কিন্তু সেদিন সুরেশ্বর বুঝেছিল কী দুঃসহ সে যন্ত্রণা হেমের, মস্ত এক অন্ধকার কুয়োর মধ্যে কেউ যেন তাকে ফেলে দিয়েছে। সুরেশ্বরও দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, বিষাদে দুশ্চিন্তায় দুঃখে তার অবস্থা হয়েছিল উদভ্রান্তের মতন। কিন্তু সুরেশ্বর এই উৎক্ষিপ্ত ভাবটা সামলে নিয়েছিল। দুঃখের সঙ্গে তার পরিচয় আগেই ঘটেছিল বলে হয়তো বিহ্বলতা কাটাতে তার সময় লাগেনি। হেমকে সুস্থ করার জন্যে সে ব্যাকুল।
এই সময় সুরেশ্বর নিঃসন্দেহে জেনেছিল, হেমকে সে ভালবাসে। জেনেছিল, হেমকে না বাঁচাতে পারলে তার চারপাশে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা সহ্যাতীত। স্বপ্ন দেখতো: মস্ত এক শূন্য মাঠে আটচালা ঘরে লোহার বিছানায় হেম একাকী শুয়ে আছে, তার চারপাশে ন ভন মাছি উড়ছে, মাটিতে মাছিতে হেমকে আর দেখা যায় না, বিছানার তলায় কলাইয়ের নোংরা গামলায় সুরেশ্বরের নাম লেখা ছোট ঘোট রুমাল, দোমড়ানো মোচড়ানো, যেন হেম হাতের মুঠো খুলে সেগুলো একে একে ফেলে দিয়েছে। সুরেশ্বর হেমের বিছানার সামনে গিয়ে দুহাতে মাছি তাড়াবার চেষ্টা করতে করতে অসহায় হয়ে কেঁদে ফেলত।
সুরেশ্বর এই একই স্বপ্ন কয়েক বারই দেখেছিল, কখনও সে সবটা দেখত, কখনও টুকরো করে দেখত। একবার সে স্বপ্নটার কথা পুরোপুরি না বললেও হেমকে বলেছিল সে আজেবাজে বিশ্রী স্বপ্ন দেখে।
কী স্বপ্ন? হেম জিজ্ঞেস করেছিল, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে।
বাজে স্বপ্ন, বিশ্রী!
আমি মরে গিয়েছি?
যাঃ, তুমি মরে যাবে কি?
তবে।
আমি মরে গিয়েছি।
মিথ্যে কথা।
বিশ্বাস হচ্ছে না…! সত্যি।
কথাটা অবিশ্বাস্য বলে সেদিন সুরেশ্বরের মনে হত না। হেম মরে গেলে সুরেশ্বর মৃত হয়েই থাকত। হেমকে বাঁচার আশা দেবার সময় সুরেশ্বর নিজেকেও যেন আশা দিত। হেমকে যখন ভরসা দিত, সাহস দিত–তখন নিজেও ভরসা ও সাহস পেত।
হেম ক্রমে ক্রমে রোগমুক্ত হয়ে উঠতে লাগল। এই সময় সুরেশ্বর দেখল, ওই নরম বয়সে হঠাৎ গভীর দুঃখের ও নৈরাশ্যের মধ্যে পড়ে হেম এমন কিছুর স্পর্শ পেয়েছে যা, তার বয়সে সচরাচর পাবার কথা নয়। সংসারের যেটা বিষাদের দিক–যেখানে অকারণে শোক, নির্বিচারে আঘাত পেতে হয়– হেম সেই বিষাদের জগৎ দেখেছিল। সুরেশ্বর নিজের জীবনে এই জগৎ আরও আগে দেখেছে, প্রায় বাল্যকাল থেকেই দেখে আসছিল। তার মা বাবা, মা বাবার সম্পর্ক, মার ভয়, মার মস্তিষ্ক বিকৃতি, বাবার চরিত্রহীনতা, নিষ্ঠুরতা, মার আত্মহত্যা–এসমস্তই তার সেই বিষাদের জগতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এমন কী, বাবার উপপত্নী ও সেই উপপত্নীর গর্ভজাত পুত্র যখন সম্পত্তির দাবি তুলে মামলার ভয় দেখিয়েছিল সুরেশ্বর তখনও এই বিষণ্ণ জগতেরই আরও একটি পরিচয় পেয়েছিল। সম্পত্তি অথবা অর্থের জন্যে সে কাতরতা অনুভব করেনি, করেছিল গ্লানি অনুভব করে, শ্রদ্ধাহীনতায়। বাবা স্ত্রীকে অশ্রদ্ধা করেছে সন্তানকেও শ্রদ্ধাহীন করে তুলেছে। অপর স্ত্রী এবং সন্তানকেও বাবা মর্যাদা দেয়নি, মালিন্য দিয়েছে শুধু। একথা কাউকে সে বলেনি যে, বাবার দ্বিতীয় পুত্রটির জন্যে সে সহানুভূতি ও বেদনা বোধ করেছিল।
কেমন করে যেন সুরেশ্বর অনুভব করল তার ব্যক্তিগত বিষাদের জগৎ আর হেমের বিষাদের জগতের মধ্যে কোথাও যেন এক ধরনের সমগোত্রীয় ভাব আছে। তারা পরস্পরকে সহানুভূতি দেখাতে পারে। সুরেশ্বর নিজের জীবনে সহিষ্ণুতা ও সহানুভূতিকে প্রসারিত করতে চাইছিল; তার মনে হয়েছিল হেমও মমতা ও ভালবাসায় পূর্ণ হতে চায়।